উপকূলে অশনিসংকেত, অসময়েও ভাঙছে বাঁধ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নদী ভাঙনে প্রতি বছর প্লাবিত হয় খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল। তবে এবার কয়রা উপজেলার মানুষের জন্য শীতকালেও নতুন করে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। সাধারণত গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে আতঙ্ক থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর গতিপ্রকৃতির পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা এই অঞ্চলের প্লাবন-ঝুঁকি এখন অসময়েও বাড়ছে।
উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার টেকসই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন আশার আলো দেখালেও, কাজের ধীরগতি ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে স্থানীয়দের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয়দের দাবি, মেগা প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি নদী চরের সবুজ বনায়ন ধ্বংস করে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। স্থানীয় সচেতন মহল আশঙ্কা করছে, এসব কারণে বাঁধের স্থায়িত্ব কমছে।
গত ৪ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) গভীর রাতে নদীতে পানির চাপ বা কোনো ঝড়ো বাতাস ছাড়াই কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মাটিয়াভাঙ্গা এলাকার বেড়িবাঁধের প্রায় ২০০ মিটার হঠাৎ ধসে পড়ে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বাঁধটির বিশাল অংশ নদীতে ভেঙে সংলগ্ন এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে পারলেও তাদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত ১১টার পর থেকেই নদীর পাড়ের মাটি সরে যাওয়ার অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মাটিয়াভাঙ্গার বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ রাতের ভয়াবহ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘চোখের সামনে দিয়ে বাঁধটা নদীতে চইলে গেল। মনে হচ্ছিল, আজই বুঝি সব শেষ; বাড়িঘর সবকিছুই বুঝি তলাই যাবেনে।’ এর আগে গত শনিবার (৬ ডিসেম্বর) রাতে মহারাজপুর ইউনিয়নের দোশহালিয়া থেকে হোগলার মধ্যকার একটি অংশের বাঁধে ফাটল দেখা দিলে স্থানীয়রা তা মেরামত করেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাঁধের স্থায়ী সংস্কার ও নদী খননে অবহেলার কারণে ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে। মাটিয়াভাঙ্গা বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশটি মেগা প্রকল্পের আওতায় থাকলেও, নাজুক অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও ঠিকাদার সংস্কারে গুরুত্ব দেননি।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. দিদারুল আলম বলেন, সুন্দরবন ঘেঁষা আড়পাঙ্গাসিয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদের মোহনার পাশে থাকা এই বাঁধটিতে এক মাস আগেই ফাটল দেখা গিয়েছিল। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানালেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কেবল দায়সারাভাবে অল্প কিছু বস্তা ডাম্পিং করা হয়েছিল।
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের আহ্বায়ক এম আনোয়ার হোসেন বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, যেখানে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে, তার আশপাশ থেকেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর চর থেকে মাটি কেটে বনায়ন নষ্ট করা হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আয়লার পর থেকে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ভাঙন দেখা গেলেও, শীতকালে এমন ভাঙন এর আগে কখনো দেখেননি।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রাণের দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। সরকার বরাদ্দ দিলেও বরাদ্দের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
পাউবোর সাতক্ষীরা–২ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আলমগীর কবির জানান, কাজ চলমান অবস্থায়ই বাঁধটি ভেঙে গেছে, রাতেই বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে পারায় এলাকা প্লাবিত হয়নি। সকাল থেকে জোরেশোরে বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।
তবে স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, রিং বাঁধের স্থায়িত্ব খুব স্বল্প ও মূল বাঁধ দ্রুত সংস্কার না হলে ধ্বসের পরিধি আরও বাড়তে পারে।

তরিকুল ইসলাম, খুলনা (কয়রা-সুন্দরবন-উপকূল)