আমারে হোটেল থাইকা বাইর কইরা দিছিল : কাঙ্গালিনী সুফিয়া
কাঙ্গালিনী সুফিয়া, এই নামেই তিনি পরিচিত পুরো বাংলাদেশে। তাঁর কথা উঠলেই হয় তো আপনার মনে পড়বে—‘পরানের বান্ধবরে বুড়ি হইলাম তোর কারণে’। অথচ বহুদন পেরিয়ে গেছে, কেউ আর তাঁকে গান গাওয়ার জন্য ডাকে না। তাই টিভি বা মঞ্চে কোথাও নেই তিনি। সাভারের টিএনটি কলোনির ছোট এক বাড়িতে দারিদ্রের মাঝেই দিন কাটছে এই শিল্পীর। তিনি চান আমৃত্যু গান নিয়ে থাকতে। নিজের গান, গান নিয়ে তাঁর ভাবনা, প্রতারিত হওয়ার কথা, নিজের পরিবার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের কাছে। তাঁর ভাষ্যেই পড়ুন কেমন আছেন তিনি।
আপনার শরীরে অবস্থা কেমন?
বয়স হইয়া গেছে, অখন আর কেমন থাকুম। গলার রগ কেমন যেন টানে আর ব্যথা করে। তার ওপর পেটের ব্যথা। ওষুধ খাইলে কিছুটা কমে, আবার বাইড়া যায়। প্রায় দুই বছর ধইরা এই অবস্থার সাথেই আছি।
এর জন্য কোনো চিকিৎসা করিয়েছিলেন?
পাঁচ-ছয় বছর আগে প্রধানমন্ত্রী পিজি হাসপাতালে আমারে রাইখা চিকিৎসা করাইছিলেন। ওইখানে ছিলাম চার মাস। চিকিৎসা করছিলেন ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্ত। কী হইছিল বা রোগের নাম কী, সেইডা জানি না। তিন বছর ভালোই ছিলাম, কিন্তু বছর দুয়েক ধইরা আগের মতো অবস্থা। কিছু খাইতে পারি না। ভাত ব্লেন্ড কইরা খাইতে হয়। ডাক্তারের আগের দেওয়া ওষুধগুলোই এখনো খাইতাছি।
আর শরীর ভালো থাকব কেমনে? আমার শরীর তো গানের শরীর। অনেকদিন কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে পারি না। কেউ ডাকে না আইজকাল, গান গাইতে না পারলে তো আমি এমনিতেই মরে যামু। গত বৈশাখে কয়েকটা অনুষ্ঠানে গান গাইছিলাম, তারপর সারা বছরই বইসা রইলাম। কোনো অনুষ্ঠানের দেখা পালাম না। আরেক বৈশাখ আইসা গেল। সকাল থাইকা অপেক্ষায় থাকি, কেউ যদি আসে গানের বায়না নিয়া। আগে খবর নিতে আসত অনেকেই, এখন আর খবরও নেয় না কেউ। অনেক দিন পর তোমরা আসলা কয়েকটা গান করলাম, অনেক ভালো লাগছে। আরে নাইচা গাইয়া সময় কাটাইছি, এখন এমন কইরা বইসা থাকলে তো মইরাই যামু।

গানের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
আমার জন্ম রাজবাড়িতে। সেইখানেই বড় হইছি। আর মনের দুখ্যে গানের সাথে যুক্ত হই। আমার মা বাবা ছিল অনেক গরিব। বাবা মাছ মাইরা যে টাকা পাইত তা চাল কিনলেই শেষ। খাওনের মাছ আর থাকত না। সারা বছর একই রকম অভাব। আমি তখন থাইকাই নিজে নিজে গুনগুন কইরা গান গাইতাম। ১১ বছর বয়সে আমারে বিয়া দেয়। বার বছরে মা হই। স্বামী আমাকে অনেক মারধর করত। এক বছরের মাইয়া নিয়া বাবার বাড়ি চইলা আসি। তখন মুসলমানরা হিন্দু মেয়েদের ওপর অনেক অত্যাচার করত। নিজের ইজ্জত বাঁচাইতে গানের সাথে জীবন বাঁধলাম। সবাই বলল একজন ওস্তাদের তালিম নিতে হয়। আমি ওস্তাদ দেবেন খ্যাপার কাছে তালিম নিয়ে গান গাওয়া শুরু করলাম।
তখন কোথায় গান করতেন?
এক সময় আমার গলার অনেক জোর ছিল। পালা গানের দমও ছিল অনেক। পালা গানে রাতের পর রাত মানুষকে আনন্দ দিছি। আবার বিভিন্ন হাটবাজার বা গ্রামের যেকোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতাম। মেয়ের বয়স যখন তিন-চার বছর তখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। আমার বাবা, বড় ভাইকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি কইরা মাইরা ফেলে। তারপর আমি মেয়েকে মায়ের কাছে রাইখা, গ্রামের পর গ্রাম গান নিয়ে চষে বেরাইছি। আশপাশের গ্রামের যেকোনো অনুষ্ঠানে গানের দাওয়াত পাইতাম। এমন কি দূরের গ্রাম শহর থাইকাও ডাক আসত।
ঢাকায় কীভাবে এলেন?
যুদ্ধের দুই তিন বছর পর যখন দেশে একটা হাহাকার শুরু হইল, তখন আমি ঢাকা হাইকোর্টের মাজারে আইসা গান গাওয়া শুরু করি। সেইখানেই জাতীয় শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতির সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমার গান শুইনা কইলেন পাগলি তো ভালো গান গায়। আমারে অনেক উৎসাহ দিতেন তিনি। অনেকের সাথে পরিচয় করাইয়া দেন আমাকে। একদিন ফজলে খোদা নামের একজন রেডিওর অফিসার, মাজারে বইসা আমার গান শুনে গাড়িতে কইরা বাংলাদেশ বেতারে নিয়ে যান। প্রথম দিনেই একুশ খান গান রেকর্ড করেন। একুশ শত টাকাও দেন। এই রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ পাইলাম। গান শুইনা বাংলাদেশ টেলিভিশন থাইকা গান গাওয়ার লাইগা ডাক আসে। তার পর তো দেশের সব জায়গাতেই গান করছি এক সময়, একুশে টিভি, বাংলা ভিশন, বৈশাখী টিভিতেও গান করছি।

বিদেশেও তো গান করেছেন আপনি, সেখানে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে?
দেশের বাইরে দুই দেশে গেছিলাম, একবার আমেরিকায়, আরেকবার লন্ডন। দুই দেশেই বাংলাদেশের অনেক মানুষের সাথে দেখা হইছে, তাদের সামনে গান করছি। সেখানে দেখছি অনেক দূরে থাইকাও বাংলাদেশের মানুষ বাংলা গান অনেক ভালোবাসে, বিশেষ কইরা সিলেটের অনেক মানুষ আছে, যারা এই গানের অনেক ভক্ত।
আমি আসলে শুধু গানই করছি, আর টাকা কামাইছে অন্যরা, যারা আমারে নিয়া গেছিল। বাংলা একাডেমির বুলবুল সাহেব আমেরিকা নিয়া গেছিল। দুদিন গান করার পর আমরা যে হোটেলে থাকতাম, সেইখানে বাংলাদেশের কোনো এক নেতা গেছিল। তিনি আমারে ডাকলে আমি উনার সাথে দেখা করার জন্য যাই। কেন দেখা করতে গেলাম তাই আমারে বুলবুল সাহেব হোটেল থাইকা বাইর কইরা দিছিল। তারপর আমি কিছুই চিনি না, কই যাব, রাস্তায় বসে কান্দা শুরু করি।
এই সময় বাংলাদেশের একজন লোক নাম আলিম রহমান, তিনি আমারে দেইখা চিনতে পারলেন। উনার রেস্তোরাঁয় খাওনোর পর আমারে তাঁর বাসায় নিয়া যান। দুই মাস ১০ দিন ছিলাম উনার ওখানে। বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠান করাইছেন আমারে নিয়া। তারপর তিনি আমারে দেশে পাঠান। কয়েক লাখ টাকাও দেন। সেই টাকায় সাভারের ছোট এই বাসাটি করি। বাংলাদেশের বড় অফিসার বুলবুল সাহেব, আমারে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা আছিল, কিন্তু টাকা তো আর দেয় নাই, হোটেল থাইকা বাইর কইরা দেওনের পর আর কোনো খবরও নেয় নাই। এত দিন ভয়ে কিছু বলি নাই । কারণ বললে যদি আর কেউ আমারে গান গাইতে না ডাকে! আরেকবার লন্ডন গেছিলাম সরকারি ভাবে। তেমন টাকা পাই নাই, পঞ্চাশ হাজার টাকা পাইছিলাম।
আপনার পরিবারের সদস্য কয়জন, পরিবার কীভাবে চলে?
আমাদের পরিবার আমার উপার্জনেই চলে। তিন নাতনি আর এক মেয়ে থাকে আমার লগে। ঘরজামাই বিয়া দিছিলাম কিন্তু সে ঘুরে বেড়ায়,সংসারের কোনো খবর রাখে না, এটাই আমার পরিবার। বার বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় আর তের বছর বয়সে মা হই। আমরা মা আর মেয়ে পিঠাপিঠি বলতে পারেন। অনেকেই মনে করে আমরা দুই বোন। এই মেয়েকে ছাড়া কেমনে থাকি বলেন। আরেক মেয়ে আছে সে কুষ্টিয়ায় থাকে। স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই আছে।
আপনার তো এখন কোনো কাজ নেই, কীভাবে চলছে সংসার ?
প্রধানমন্ত্রী আমারে ১০ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে দেন, সারা মাস দোকান থাইকা বাকিতে খাই, আর মাসের শুরুতে টাকা পাইয়া দোকানিরে শোধ করি। কারেন্ট বিল, কিছু ওষুধ লাগে, এরপর কোনো মতে মাস পার করি।
জীবনের পুরুটা সময় তো গান করেই কাটালেন, বাকি সময়টা কীভাবে কাটাতে চান?
আমার জীবনের এখন একটাই চাওয়া। সরকার এই টিএনটি কলোনিতে আমাকে ছোট একটা জায়গা দিছে। নিজের চেষ্টায় থাকার মতো একটি বাড়ি করছি। এখন যদি কেউ আমারে একটু সাহায্য করে বা সরকার যদি আগাইয়া আসে তা হইলে আমি আমার এই বাড়িতে একটা একাডেমি করতে চাই। ছোট ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের গান গাইব আমার সামনে বইসা, তাদের তালিম দিমু। পাশাপাশি মাসে একটিও যদি কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে পারতাম, মঞ্চ অথবা কোনো টিভি চ্যানেলে। মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত গান নিয়ে যদি থাকতে পরতাম। যদি এই শান্তিটা নিয়ে মরতে পারতাম! আমার এটাই চাওয়া।

মাজহার বাবু