বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যা : করণীয় কী?

Looks like you've blocked notifications!
বিষণ্ণতা আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়। ছবি : সংগৃহীত

বিষণ্ণতা বর্তমানের প্রচলিত সমস্যা। দীর্ঘদিন কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া মন খারাপ থাকলে একে বিষণ্ণতা বলে। ঘুমের সমস্যা, কাজকর্মে আগ্রহ না থাকা, নিজেকে মূল্যহীন মনে করা ইত্যাদি বিষণ্ণতার লক্ষণ। বিষণ্ণতা জটিল পর্যায় হলো, আত্মহত্যার প্রবণতা।

বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে কথা বলেছেন সাইকোলজিস্ট রোজীনা বেগম। বর্তমানে তিনি বিআরবি হসপিটালে মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৯৫তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়। 

প্রশ্ন : বিষণ্ণতা বলতে আসলে কী বোঝানো হয়?

উত্তর : বিষণ্ণতা খুব প্রচলিত একটি রোগ এই নামটা আমরা সবাই শুনে থাকি ব্যক্তি যখন খুব খারাপ লাগা অনুভব করে, কোনো কাজেকর্মে আগ্রহ না পায়, কোনো কাজে শক্তি না পায়, খাবারের চাহিদা বেড়ে যায় বা কমে যায়, ঘুম বেড়ে যায় বা কমে যায়, নিজেকে মূল্যহীন মনে করে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, মনোযোগ কমে যায়, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে- এসব লক্ষণগুলো যদি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়, তাহলে আমরা একে বিষণ্ণতা বলি

প্রশ্ন : অনেক সময় তো আমাদের খারাপ লাগা, ভালো না লাগা তৈরি হয়। তাহলে বিষণ্ণতার সঙ্গে এর পার্থক্য কী?

উত্তর : আমরা আসলে ডিপ্রেস মুড বা ডিপ্রেশন দুটোকে আলাদা করতে পারি না। ডিপ্রেস মুড হলো, একটি লক্ষণ, যেটি খুব ক্ষণস্থায়ী, অল্প সময়ের মধ্যে চলে যেতে পারে। কোনো একটি ঘটনায় আমার মন খারাপ হয়েছে, আমি শপিংয়ে যাব, যেতে পারলাম না, মন খারাপ হয়েছে, তবে পরে দেখা গেল, আমি যখন চলে গেলাম ওই কাজে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। তো ডিপ্রেশন আমরা তখনই বলব, যখন এটি কোনো রোগ। আগেই আমি কিছু লক্ষণের কথা বলেছি। ঘুমের সমস্যা হবে, কাজ করতে আগ্রহ পাবো না, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, নিজেকে মূল্যহীন মনে হবে এবং মৃত্যুর চিন্তা আসবে। এই সমস্যাগুলো দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হবে। একে আমরা বিষণ্ণতা বলছি। আর এটি একটি রোগ।

প্রশ্ন : কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন?

উত্তর : এটা অবশ্যই পরিবারের সদস্যরা লক্ষ্য করবে। পরিবারের সদস্যরা হয়তো দেখে ব্যক্তির মধ্যে খুবই উচ্ছাস ছিল, তার মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন। কোনো কিছু তার ভালো লাগছে না। কথায় কথায় বলছে, মরে যেতে ইচ্ছে করে। মেজাজ দেখাচ্ছে। এমন সময়ে কিন্তু আমরা তাকে সাধারণ পরামর্শ দিয়েই কাটাতে চাই। হয়তো পরিবারের মানুষ বলে, এগুলো ঠিক হয়ে যাবে, এগুলো কিছু না। একটু ঘুমাও বা একটু ঘুরে আসো ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের আসলে রোগ সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান না থাকার কারণে আমরা এগুলো বলি।

আমরা যদি জানতে পারি বিষণ্ণতা কী- এটি একটি রোগ, সাধারণ খারাপ লাগা নয়, তাহলে আমরা তাকে সহযোগিতা করবো। পরে যদি দেখা যায়, নিজের সহযোগিতায় সমস্যা না কাটে, তাহলে কাউন্সেলরের সহযোগিতা নিতে হবে। না হলে কিন্তু আত্মহত্যার  যে চিন্তা আসে, ব্যক্তি সেটির উদ্যোগ নেয়। পরে দেখা যায়, সেটি সফল হয়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন : আত্মহত্যার সঙ্গে বিষণ্ণতার সম্পর্ক কোথায়?  

উত্তর : বিষণ্ণতার সবচেয়ে ভয়াবহতা কোথায়? সেটি হলো আত্মহত্যা। কেন আমরা বিষণ্ণতাকে খুব গুরুত্ব দেব? কারণ, আপনি বিষণ্ণতায় আছেন, কাজ করছেন না। ঠিক আছে, মেনে নেওয়া গেল। তবে এর চেয়ে বেশি যখন হচ্ছে, এই যে তার আত্মহত্যার চিন্তা সবসময় আসছে, একটি সময় কিন্তু তার জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তো একে একদমই অবহেলা করা যাবে না।

প্রশ্ন : বিষণ্ণতা নিয়ে যখন রোগীরা আসে, তখন প্রাথমিকভাবে কী করেন? প্রাথমিক পরামর্শ কী থাকে?

উত্তর : এর আগে একটু বলব, আসলে পরিবারের সদস্যরা অনেক শেষে বুঝতে পারেন যে আসলে তার সমস্যা রয়েছে। অন্যান্য চিকিৎসকে কাছে যখন কাজ হয় না, তখন দেখা যায়, আমাদের কাছে আসছেন, পরে আমরা তার সঙ্গে কথা বলছি এবং লক্ষণগুলো জানতে পারি যে তার কিছুই ভালো লাগে না কেন। এরপর তার সমস্যাটা জানার চেষ্টা করি এবং এটি যে একটি রোগ, এই সম্পর্কে আমরা তাকে ধারণা দিই। যেহেতু এটি রোগ ও চিকিৎসাযোগ্য রোগ, চিকিৎসা করলে সে আগের মতো হয়ে যাবে এবং নিজেকে আগের মতো বা আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় ফেরত পাবে ওই জায়গায় আমরা তাকে প্রথমে নিশ্চিত করি এবং পরে আমরা চিকিৎসাকে নিয়মিত করি। 

প্রশ্ন : কী কারণে বিষণ্ণতায় পড়েছে, সেটি কি নির্ণয় করা  প্রয়োজন?

উত্তর : অবশ্যই। আমরা যখন চিকিৎসা করি, সাইকোথেরাপি বা টক থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করি, আমাদের খুঁজতে হয় বিষণ্ণতার কারণটা কী, কোথা থেকে তার এই সমস্যাটা শুরু হলো। আমাদের জীবন আসলে খুব স্বাভাবিকভাবে যায় না, উঠা-নামা নিয়েই জীবন হয়। তো যারা বিষণ্ণতায় ভুগছেন, আমাদের চিন্তা করতে হয়, কোন জায়গাটায় তিনি খারাপ বোধ করছেন, কোন জায়গাটাতে তিনি একদম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নাই, এটা আমরা ইতিহাস নেওয়ার মাধ্যমে নির্ণয় করি। বর্তমান থেকে আমরা অনেক সময় শৈশবে চলে যাচ্ছি। কোন জায়গায় তিনি বাধা বোধ করছেন, তার সম্পর্কগুলো কেমন, কোনো সমস্যা রয়েছে কি  না, এরপর প্রিয়জনের মৃত্যু রয়েছে কি না, কোনো হতাশা আছে কি না- এগুলো আমরা বের করার চেষ্টা করি। থেরাপিউটিক জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা নির্ণয় করি, কারণটি কোথায়।

প্রশ্ন : আপনারা কীভাবে কথা বলার মাধ্যমে বা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগীদের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন?

উত্তর : তার আগে একটু বলব, আমাদের এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসেরও প্রতিপাদ্য ছিল, বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা রোধ। তো এটি কিন্তু বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা।

আমরা কথা বলার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে একজন বিষণ্ণতার রোগীকে সাহায্য করতে পারি। প্রাথমিকভাবে আপনি কী করবেন? আপনার আশেপাশের আপনজন, বন্ধু, পারিবারিক মানুষের সঙ্গে আপনি কথা বলেন। যখন আপনি তার সঙ্গে কথা বলছেন, তখন সে তার ভেতরের কষ্টগুলো বলছে। শুধুমাত্র কথা বলার মাধ্যমে। হয়তো সেটি বিজ্ঞানভিত্তিক হচ্ছে না, তবে শুধু মনোযোগ দেওয়ার কারণে অনেকটা কাজ হচ্ছে। তাকে উড়িয়ে না দেওয়া। এগুলো না বলে তাকে সহযোগিতা করা। এগুলো মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, তার অস্থিতিশীলতা কমে, সহযোগিতা পায়। এক সময় সে বলেই ফেলবে হয়তো ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে’। তাকে তখন ফিরিয়ে আনাটা হয়তো সহজ হয়। তখন কিন্তু পাশের মানুষটা বুঝতে পারছে, তার কেমন সাহায্য দরকার।

প্রশ্ন : বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য কোনো মেডিকেশন বা ওষুধের  প্রয়োজন রয়েছে কি?

উত্তর : হ্যাঁ, অবশ্যই ওষুধের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ডাব্লিওএইচওর মতে, আমরা বিষণ্ণতার চিকিৎসা করতে পারি, সাইকোথেরাপি অথবা টক থেরাপির মাধ্যমে, অথবা অ্যান্টি ডেপ্রেশেন্টের মাধ্যমে অথবা দুটো একসঙ্গে নিয়ে। দুটোর সমন্বয়ে একটি চিকিৎসা করা যেতে পারে। 

প্রশ্ন : আত্মহত্যা প্রবণতার একটি বড় কারণ বিষণ্ণতা। তাহলে বিষণ্ণতা রোধে কী করণীয়?

উত্তর : ব্যক্তি একটি পরিবারের অংশ। আমরা যদি পারিবারিক সম্পর্কটাকে সাহায্য করতে পারি, যোগাযোগ, গুণগত সময় রাখতে পারি, তাহলে উপকারী। এগুলো মানসিক সুস্থতার বড় একটি কারণ। অনেক মানসিক রোগ তাহলে কমে যায়। আমাদের  পারিবারিক বন্ধনটাকে উন্নত করা, সন্তানদের সময় দেওয়া, প্রশংসা করা, তাদের সময় দেওয়া, ছুটির দিনে তাদের নিয়ে বাইরে যাওয়া বা বাসার মধ্যে কিছু ইনডোর গেমের ব্যবস্থা করা, মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনা- এগুলো করতে হবে।

বাচ্চাদের সময় দেওয়ার দরকার রয়েছে, তেমনি নিজেদেরও সময় দেওয়ার দরকার রয়েছে। একটি শিশু যখন পরিবারে বড় হচ্ছে, বাবা-মাকে দেখছে এভাবে, তারাও কিন্তু সুস্থভাবে নেই। পারিবারিক বন্ধনটা মজবুত করতে হবে।

প্রশ্ন : একবার আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে ফিরে আসলে পরে আবার তার এই প্রবণতা ফিরে আসতে পারে কি না বা বিষণ্ণতার একবার চিকিৎসার পর আবার এটি ফিরে আসতে পারে কি না?

উত্তর : আমার যদি একবার সর্দি- ঠাণ্ডা লেগে যায়, আমি যদি চিকিৎসা নিয়ে ভালো হই, আবার কিন্তু ওই একই রোগ হতে পারে। ঠিক তেমনি মনের রোগও কিন্তু তাই। আমি একবার সুস্থ হওয়ার পর আবারও জীবনে চলার পথে কষ্ট, ক্ষোভ,পঞ্জিভূত হতে পারে, এমন হতে পারে যে আমি আর নিতে পারছি না, আবার বিষণ্ণতায় চলে গেলাম। এমনটা হতেই পারে।

সাইকোথেরাপি বা টক থেরাপিতে আমরা কেবল ব্যক্তিকে বিষণ্ণতা থেকে বের করে নিয়ে আসি না্, পাশাপাশি আমরা প্রশিক্ষণ দিই কীভাবে আবারও আপনার বিষণ্ণতা হলে আপনি নিজে নিজে সে জায়গা থেকে বের হয়ে আসবেন। মূলত, আমাদের জায়গাটা থাকে, স্বশিক্ষিত করার। মনের শক্তিটাকে আরো বাড়িয়ে দেওয়া। পরে যদি সে না পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে আবারও সে যোগাযোগ করতে পারে।

পারিবারিক থেরাপিটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারকেও সচেতন করা আমাদের চিকিৎসার একটি অংশ। আমরা তাদের বলি, এটি একটি রোগ। একে অবহেলা করবেন না। আমরা পরিবারের মানুষদের বলি, ‘আপনারা কখনো একে হালকাভাবে নেবেন না’। আপনার পরিবারের কোনো সদস্য যদি বিষণ্ণতায় থাকে, তাকে গুরুত্ব দেন, তার সঙ্গে কথা বলেন। প্রয়োজনে প্রফেশনাল সাহায্য নেন।