ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সারভাইভাল ডে
বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার পরিস্থিতি

আজ ২ জুন, ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সারভাইভাল ডে বা ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার দিবস। এ উপলক্ষে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৫৪তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক।
প্রশ্ন : আজ ক্যানসার সারভাইভাল ডে। শুরুতে যদি একটু বলে নেন এর অর্থ কী?
উত্তর : সারভাইভাল মানে বাঁচিয়ে রাখা। একজন রোগীকে ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়ার পর যদি ন্যূনতম পাঁচ বছর বাঁচে তখন একে সফল চিকিৎসা ধরে নেওয়া হয়। আর পাঁচ বছরের মধ্যে যতজন রোগী বেঁচে থাকে তার শতকরা হিসাবকে সার্ভাইভাল রেট বলা হয়।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের মানুষরা বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে কোন কোন ক্যানসারে?
উত্তর : আমাদের দেশে সাধারণত পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি আক্রান্ত হয় ফুসফুসে ক্যানসারে। মুখ গহ্বর ও গলার ক্যানসারে। আর নারীর ক্ষেত্রে হয় জরায়ু ও স্তনের ক্যানসার। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যানসার রয়েছে। যেমন : পাকস্থলির ক্যানসার, রক্তের ক্যানসার। এছাড়া বাচ্চাদের হতে পারে লিম্ফোমা।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের যে প্রচলিত ক্যানসারগুলোর কথা বললেন এগুলোর সারভাইভাল রেট কেমন? অর্থাৎ পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব বেঁচে থাকছেন চিকিৎসা নিয়ে তাঁদের হার কেমন?
উত্তর : বিশ্বের সাথে তুলনায় একই রকম। ক্যানসারের ক্ষেত্রে সাধারণত এটা নির্ভর করে ধাপের ওপর। ক্যানাসারের ক্ষেত্রে সাধারণত শূন্য, এক, দুই, তিন, চার এই পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে। যদি প্রথম দিকে (আর্লি স্টেজে ) ধরা পড়ে তাহলে চিকিৎসা দিলে এ দেশের রোগীরা যত দিন বাঁচবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের রোগীরাও তত দিন বাঁচবে।urgentPhoto
প্রশ্ন : তবে অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসারের চিকিৎসায় ভালো হওয়ার হার কম দেখা যায় ... ...
উত্তর : আমাদের দেশের রোগীদের ক্যানসার দেরিতে ধরা পড়ে। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে ওই রোগী অনেক দিন বাঁচবে। ক্যানসার হওয়ার পর রোগীরা হয়তো প্রথমে গ্রামের চিকিৎসকের কাছে যায়। তারপর পার্শ্ববর্তী দেশের কোনো চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে । আবার হয়তো টাকা-পয়সা না থাকার কারণে তারা ঠিকমতো চিকিৎসকের কাছে আসে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার হারটা কম থাকে, কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে না এসে অনেক দেরিতে আসছে। যার কারণে তার বেঁচে থাকার হার কমে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : এমনকি আমাদের চিকিৎসকদের মধ্যে রেফারেলের মানসিকতাও বেশি নেই ... ...
উত্তর : হ্যাঁ , রোগ ধরা পড়ার সাথে সাথে একজন চিকিৎসক কোনো ক্যানসার চিকিৎসকের কাছে রেফার করবে সেই বিষয়টিও কম।
প্রশ্ন : চিকিৎসার ক্ষেত্রে আপনারা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন- স্টেজ বা পর্যায়। কোন পর্যায়ে রোগী এলো তার উপর ভিত্তি করে আপনারা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এই পর্যায়ের বিষয়টি কী?
উত্তর : এই পর্যায় হলো সাধারণত টিএনএম। টি অর্থ টিউমার। টিউমারের পরিমাণটা কতটুকু। বিভিন্ন পরিমাপের ওপর ভিত্তি করে টিউমারটাকে ভাগ করা হয়। এন হচ্ছে নোড, ক্যানসারে গ্রন্থিগুলো আক্রান্ত হয়, কতগুলো গ্রন্থি আক্রান্ত হলো, মাংস পেশির সাথে যুক্ত কি না এগুলোর ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব করা হয়। এম টাকে আমরা বলি মেটাডিজিজ অর্থাৎ রোগটি অন্য কোনো অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কি না এটি দেখা হয়। এই তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আমরা পর্যায়গুলো শূন্য, এক, দুই... এভাবে নির্ধারণ করি।
প্রশ্ন : এই পর্যায়গুলো চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে কী করে? একজন রোগী কতটুকু ভালো হবে এর সঙ্গে পর্যায়ের সম্পর্ক কী?
উত্তর : ধরুন, জরায়ুর ক্যানসারের কথা। যদি একটি রোগী শূন্য পর্যায়ে থাকে তাহলে তার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। যদি পর্যায়- এক এ আসে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ থেকে ১০০ ভাগ। পর্যায় দুইয়ে এলে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা। আর যদি পর্যায় চার এ আসে তবে ২০ শতাংশেরও কম। তাই পর্যায় বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ তার ভালো হওয়ার জন্য। যত প্রাথমিক পর্যায়ে আসবে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের রোগীদের প্রাথমিক পর্যায়ে আসার হার কেমন এবং দেরিতে আসার হার কেমন?
উত্তর : এ বিষয়ে আমাদের জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমীক্ষা নেই। তবে আমরা যতগুলো রোগী পাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ রোগী দেরিতে আসে। বেশির ভাগ রোগীকে আমরা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা দেই।
প্রশ্ন : পেলিয়েটিভ চিকিৎসার মানে কী?
উত্তর : পেলিয়েটিভ চিকিৎসা মানে হচ্ছে কেবল রোগীর উপসর্গগুলো দূর করার জন্য চিকিৎসা করা হয়। যেমন : ব্যথা থাকলে এর ওষুধ দেওয়া হয়, রোগীর বমি হচ্ছে সেটি বন্ধের জন্য চিকিৎসা দিচ্ছি। রক্তক্ষরণ হচ্ছে রক্ত ব্ন্ধ করার জন্য আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। রোগীর হয়তো খাওয়া ব্ন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে তাকে বাইপাস সার্জারি করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে রোগীর ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শুধু যত দিন রোগী বেঁচে আছে তত দিন কষ্ট যাতে কম হয়।
প্রশ্ন : ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা দেখি, কিছু আছে কেবল সার্জারিতে ভালো হয়। কিছু ক্যানসার সার্জারির ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি দিতে হয়, ক্যামোথেরাপি দিতে হয়। আবার কোনোটি শুধু রেডিও থেরাপি বা ক্যামোথেরাপি দিতে হয়। এটা নির্ধারণ করেন কীসের ওপর?
উত্তর : এটি নির্ভর করে শরীরের ক্যানসারটা কোথায়, কী ধরনের ক্যানসার তার ওপর ভিত্তি করে। ধরুন একটি জরায়ুর ক্যানসার পর্যায় এক এ আছে, সে ক্ষেত্রে সার্জারি করা যেতে পারে। সার্জারি করার পর যদি রেডিয়েশন লাগে সেটিও দেওয়া যেতে পারে।
আবার ধরুন একটি জরায়ুর ক্যানসার পর্যায় দুই বি। পর্যায় এক পর্যন্ত অস্ত্রপচার করা যায়। কিন্তু পর্যায় দুই -বি তে চলে গেলে তখন আর অস্ত্রপচার করা যায় না। সেই ক্ষেত্রে আমরা রেডিয়েশন থেরাপি দিয়ে থাকি। রেডিয়েশনের পাশাপাশি আমরা সপ্তাহে একট করে ইনজেকশন দিয়ে থাকি।
প্রশ্ন : রেডিও থেরাপির ক্ষেত্রে একজন মানুষের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
উত্তর : রেডিয়েশন থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এটা নির্ভর করে কোথায় রেডিয়েশন দিচ্ছি, কতটুকু জায়গা রেডিয়েশন দিচ্ছি তার ওপর নির্ভর করে। ধরা যাক একজন ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীকে রেডিয়েশন দেওয়া হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে রোগী স্বাভাবিক লক্ষণ বমি বমি ভাব হতে পারে। দুর্বল লাগতে পারে। রোগীর চামাড়ায় কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, লাল লাল হতে পারে। ফুসকুরি দেখা দিতে পারে। কালো হয়ে যেতে পারে। ঘা হতে পারে। আবার রোগীর খাওয়ার সমস্যাও হতে পারে। এগুলো হলো চিকিৎসাকালীন সমস্যা।
আবার কিছু কিছু সমস্যা দেরিতে হতে পারে। সেগুলোর ক্ষেত্রে ফাইব্রোসিস হতে পারে ফুসফুসের মধ্যে। হলে রোগীর কাশি হয়। রোগীর বুকে ব্যথা হতে পারে। অথবা খাদ্যনালি চিকন হয়ে যেতে পারে। এর ফলে রোগীর খাওয়ার সমস্যা হতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে প্রাথমিক যেই সমস্যাগুলো হয়, এগুলো সাময়িক চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো রাখা সম্ভব।