জন্ডিস প্রতিরোধে করণীয়
জন্ডিস সবার কাছে পরিচিত একটি শব্দ। কমবেশি সবাই এই রোগ সম্বন্ধে জানেন। সময়মতো এর চিকিৎসা না করা হলে রোগ জটিল হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। আজ ২৪ জুন এনটিভির স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২০৭৬তম পর্বে জন্ডিস ও এর প্রতিরোধের বিষয়ে কথা বলেছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম আজম।
urgentPhoto
প্রশ্ন : জন্ডিস রোগটি কী এবং কেন হয়?
উত্তর : জন্ডিস একটি ইংরেজি শব্দ। আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। তবে জন্ডিসের যে বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা সেটা হলো, রক্তে বিলিরুবিন নামক একটা রঞ্জক পদার্থ বেড়ে গেলে তাকে আমরা জন্ডিস বলি। অনেকগুলো উপসর্গের মাধ্যমে এটা দেহে প্রকাশ পায়। যেমন : চোখ হলুদ হয়ে যায়, যারা একটু বেশি ফর্সা তাদের গায়ের রং হলুদ হয়ে যেতে পারে, প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়- এগুলোই হলো প্রাথমিক লক্ষণ।
প্রশ্ন : একজন রোগী শুধুমাত্র কি এই লক্ষণগুলো দিয়েই বুঝবে তার জন্ডিস হয়েছে?
উত্তর : গায়ের রং হলুদ হওয়া বা প্রস্রাব হলুদ হওয়া এগুলো তো একধরনের লক্ষণ, যা রোগী নিজে বুঝতে পারে। এর পাশাপাশি অন্যান্য উপসর্গও থাকে। যেমন, রোগীর ক্ষুধা কমে যাবে, বমির ভাব হবে অথবা বমি হবে। রোগীর অনেক সময় পাতলা পায়খানা হতে পারে, পেটে ব্যথা হতে পারে। কারো অল্প জ্বর হতে পারে।
প্রশ্ন : জন্ডিস হওয়ার পেছনে কারণ কী?
উত্তর : জন্ডিসের কারণ প্রথমে আমরা বয়স ভেবে চিন্তা করি। আমাদের কাছে রোগী এলে প্রথমে বয়সটাকে চিন্তা করি। অল্প বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এর কারণ একরকম, আর বড়দের ক্ষেত্রে আরেক রকম। ভাইরাল হেপাটাইটিস আমাদের দেশের জন্ডিসের খুব প্রচলিত একটি কারণ। তা ছাড়া আমাদের লিভারের অন্যান্য অসুখের কারণে জন্ডিস হয়। আবার আরেকটি বিষয় বলতে চাই, লিভার সুস্থ থেকেও জন্ডিস হতে পারে। কারো যদি রক্ত ভাঙার অসুখ থাকে, যেমন থেলাসেমিয়া একটা অসুখ, এটি থাকলে জন্ডিস হতে পারে। আবার কারো লিভার ভালো, থেলাসেমিয়া নেই, তারও জন্ডিস হতে পারে। যেমন বাধাজনিত বা অবসট্রাকটিভ জন্ডিস। সেই ক্ষেত্রে পিত্তনালিতে পাথর হলেও হতে পারে বা পিত্তথলির ক্যানসার হলে হতে পারে। পেনক্রিয়াস নামের আমাদের শরীরে যে অঙ্গ, তার মাথায় যদি ক্যানসার বা কোনো অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় তাহলেও জন্ডিস হতে পারে।
প্রশ্ন : এই যে বিভিন্ন ধরনের জন্ডিসের কথা বলছিলেন উপসর্গগুলো কি একইভাবে প্রকাশ পায়?
উত্তর : অবশ্যই না। উপসর্গগুলো আমরা বিশ্লেষণ করি পরীক্ষার মাধ্যমে। তবে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার আগে আমরা একটা ধারণা পেয়ে যাই। যেমন, যাদের থেলাসেমিয়া থাকবে তাদের এর সঙ্গে এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতাও থাকবে। যাদের বাধাগ্রস্ত বা অবসট্রাকটিভ জন্ডিস থাকবে তাদের গা চুলকাতে পারে। তারপর তার টিউমারটা হতে পারে। এরপর তার রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যার কারণে রক্তবমি বা কালো পায়খানা হতে পারে। এগুলো আমরা নির্ণয় করতে পারি ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করার আগে।
প্রশ্ন : রোগনির্ণয়ের পর কোন ধরনের চিকিৎসা করা হয়?
উত্তর : জন্ডিস হলেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এমন নয় বা আমাদের খুব চিন্তিত হতে হবে, সেটি নয়। আমরা যেটা জানি, জন্ডিস অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাল হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাস, খাদ্য বা পানিবাহিত, সেটা এমনি এমনি ভালো হয়ে যেতে পারে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, বিলিরুবিন যদি অতিরিক্ত বেড়ে যায় এবং পাশাপাশি রোগীর কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেমন, ক্ষুধামান্দ্য বেশি হয়, বমি হয় তাহলে সে শকে চলে যেতে পারে। ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীন হতে পারে। এগুলোর কিছু লক্ষণ দেখলে আমরা তাকে রক্ত পরীক্ষা করতে বলি এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা হয়। কিছু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করা। আর কয়েকটি ওষুধ আমরা দিই। যেমন, বমি হলে এর ওষুধ। মূলত লক্ষণ বুঝেই এর চিকিৎসা আমরা দিই। নির্দিষ্ট চিকিৎসা লাগে অবসট্রাকটিভ জন্ডিস হলে। টিউমার থাকলে তার অস্ত্রোপচার করতে হবে। অথবা থেলাসেমিয়ার জন্য যদি হয় সে ক্ষেত্রে তো অবশ্যই ভিন্নভাবে চিকিৎসা করতে হবে।
প্রশ্ন : সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে জটিলতা কী কী হতে পারে?
উত্তর : রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা খুবই দরকার। আমাদের গ্রামাঞ্চলে বা শহুরে মানুষের ভেতরে একটি ধারণা, কবিরাজরা এর চিকিৎসা করতে পারেন। এর ফলে অপচিকিৎসকের কাছে চলে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, গিয়ে তারা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। এর ফলে জটিলতা আরো বেড়ে যাচ্ছে। ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে জন্ডিস এমনিতেই ভালো হয়ে যেতে পারে। তাই আমরা তাদের কিছু বিষয়ে শুধু সাবধান করে দিই। যেমন, বলি, আখের রস খাওয়ার কোনো দরকার নেই। এর আলাদা কোনো উপকারিতা নেই। বরং ডায়াবেটিস থাকলে তার শর্করা বেড়ে যাবে। এক গ্লাস আখের রস খেলে পরের বেলার খাবার খাওয়ার ক্ষুধা তার আরো কমে যাবে। তাই আমরা আখের রস খাওয়া, ঝাড়ফুঁক করা এগুলো করতে নিষেধ করি এবং বৈজ্ঞানিক নিয়মে চিকিৎসা করতে বলি।
সহজ কতগুলো রক্তের পরীক্ষা, লিভার ফাংশন টেস্ট, একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে বলি। এই পরীক্ষাগুলো বাংলাদেশের সব জায়গায় হয়। তাই আমরা বৈজ্ঞানিক নিয়মেই এটা নির্ণয় করতে পারি। কারণটা জেনে সঠিক চিকিৎসা করতে পারি। আমার অভিজ্ঞতায় বলি, ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জন্ডিস চিকিৎসাযোগ্য এবং ভালো হয়।
প্রশ্ন : আর যদি জটিলতা হয় সে ক্ষেত্রে কতখানি গুরুতর হতে পারে?
উত্তর : জটিলতা যা হতে পারে সেটি হচ্ছে, শুরুতেই একিউট লিভার ফেইলিউর হতে পারে। শুরুতেই হয়তো দেখা যাচ্ছে রোগীর বিলিরুবিন বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত। রোগীকে আমরা বলে দিই যদি মানসিক সমস্যা হয়। হয়তো বাসায় তার স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এটা ঝুঁকির। এরপর তার যদি রক্তবমি বা কালো পায়খানা হয়, অথবা তার গায়ে অনেক জ্বর আসে। সেই ক্ষেত্রে আমরা বলব এটা ঝুঁকির এবং আপনার বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন। সে সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : এ ছাড়া যদি সাধারণ জন্ডিস হয়, তাহলে ফলোআপের জন্য কখন যেতে বলেন?
উত্তর : যখন রোগী আমাদের কাছে আসে, তখন কিছু প্যারামিটার দেখি। বিলিরুবিন, পথ্রোমবিনটাইম, সিরাম এলপি ইত্যাদি দেখে সেই প্যারামিটারের সাপেক্ষে তার চিকিৎসা করি। যদি হাসপাতালে ভর্তি না করেন, তাহলে সাতদিন পর কিছু টেস্ট করতে বলি। আর হাসপাতালে থাকলে তো নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসা করি। আর হাসপাতালে না থাকলে সাত থেকে ১০ দিন পরপর আসতে বলি।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের বিষয়গুলো একটু দর্শকদের জন্য বলুন।
উত্তর : আমরা জানি যে জন্ডিসের জন্য হেপাটাইটিস একটা কারণ এবং অন্যতম কারণ, আমাদের দেশে যেখানে সানিটেশন ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। এখন বৃষ্টির দিন আমরা যদি দূষিত পানি পান করি তাহলে জন্ডিস হতে পারে। এই বর্ষাকালেই এই রোগ আমাদের দেশে বেশি হয়। অতএব বিশুদ্ধ পানি পানের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে।
আর এই সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বাইরের পানি, ফল, খোলা জায়গায় যেগুলো বিক্রি করে সেগুলোও খেতে গেলে সতর্ক হতে হবে। অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাওয়া উচিত। আর হেপাটাইটিস বি, এর প্রতিরোধক টিকা রয়েছে এগুলো নেওয়া উচিত। আর হেপাটাইটিস সি কে প্রতিরোধ করতে রক্ত নেওয়ার আগে স্ক্রিনিং করে নিতে হবে। এই বিষয়গুলোতে সচেতন থাকলে এই জাতীয় জটিলতা থেকে অনেক ক্ষেত্রেই মুক্ত থাকতে পারব।