বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস
হেপাটাইটিসজনিত মৃত্যুরোধে সচেতন হোন
আজ ২৮ জুলাই, বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। সারা পৃথিবীতেই পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সারা পৃথিবীতেই এখন ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি অন্যতম মৃত্যুদূত হিসেবে পরিচিত। এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন সংক্রামক রোগগুলো এক এক করে পরাভূত হচ্ছে, তখন ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস তার ভয়ংকরী রূপ নিয়ে এখনো স্বমহিমায় বর্তমান। তাই একটি নির্দিষ্ট মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এই ভাইরাসকে রুখে দিতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে তাই এবারের প্রতিপাদ্য ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে মুখর হোন’।
বলা হচ্ছে, হেপাটাইটিস এখন গ্লোবাল এপিডেমিক (বৈশ্বিক মহামারী)। এটি অঞ্চলবিশেষের রোগ নয়। যে দুটি বিশেষ ভাইরাসকে নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তা তা হলো, হেপাটাইটিস বি ও সি। দুটোই ছড়ায় রক্ত ও যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে।
বি হেপাটাইটিসজনিত লিভারের অসুখে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন মানুষ। এটি এইচআইভি, টিউবার কুলোসিসের সমান প্রায়। অথচ যেভাবে আমরা এইচআইভির জন্য সচেতনতা গড়ে তুলছি, সেভাবে হেপাটাইটিস নিয়ে সচেতন হচ্ছি না।
হেপাটাইটিস একটি নীরব ঘাতক। শরীরে ঘাপটি মেরে থেকে শরীরকে অনেক দিন পর্যন্ত কোনোরকম জানান না দিয়েই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ ভাগ মানুষ হেপাটাইটিস বি ও ৮০ ভাগ মানুষ হেপাটাইটিস সি’র খবর বলতে পারেন না, যদিও তারা শরীরে নিয়ে ঘুরছেন এই মৃত্যুঘাতক।
হেপাটাইটিস বি ও সি শতকরা ৮০ ভাগ লিভার ক্যানসারের জন্য দায়ী। সুতরাং বিষয়টি খুব সহজ নয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, হোপাটাইটিস ‘বি’র ভ্যাকসিন বাজারে বেরিয়েছে প্রায় দুদশক হলো। এখনো মানুষের ভেতর এ ব্যাপারে তেমন সচেতনতা নেই। বাংলাদেশ সরকার ইপিআই শিডিউলে হেপাটাইটিস ‘বি’র ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দিচ্ছে। সেটাও বেশ কবছর হলো। কিন্তু যাঁরা দুই হাজার সালের আগে জন্মেছেন, তাঁরা তো আর সেটা পাননি। অথচ ভ্যাকসিন নেওয়ার উদ্যোগ তাঁদের মধ্য তেমন নেই।
হেপাটাইটিস বি ও সি দুটোরই অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বেরিয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া সম্ভব। কিন্তু রুটিন স্ক্রিনিং করে এই নীরব ঘাতককে শনাক্ত করার চেষ্টাও সেভাবে দেখা যায় না। এতে অধিকাংশ রোগী ডাক্তারের কাছে আসেন লিভারকে একেবারে নাজুক বানিয়ে। তত দিনে ভাইরাস তার ঝাড়েবংশে বাড়বাড়ন্ত। অনেকে লিভার ক্যানসার হওয়ার পর জানতে পারেন, শরীরের ভাইরাস ছিল।
তাই ভাইরাসের রুটিন স্ক্রিনিং জরুরি। বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন যেহেতু পাওয়া যায়, তাই নিয়ে ফেলাটা কর্তব্য। বি ও সি ছাড়া আরো যে দুটি ভাইরাস আমাদের দেশে খুব পাওয়া যায়, তা হলো হেপাটাইটিস ই ও এ। এই দুটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেলফ লিমিটিং। বিশ্রাম নিলে ও কিছু সাহায্যকারী চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যায়। তবে সবক্ষেত্রে নয়। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে ই ভাইরাস বেশ ভয়ংকর।
রক্তে হেপাটাইটিস বি বা সি পেলেই আপনি নির্ঘাত মারা যাবেন, এমনটা ভাবারও কারণ নেই। এসব ভাইরাস নীরবেই থেকে যায় শরীরে। তবে সচেতন থাকা জরুরি। রক্তে ভাইরাসের মাত্রা, লিভারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে তবেই নিশ্চিত হওয়া যায় কতটা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে সে।
হেপাটাইটিসের লক্ষণ হলো পেটে ব্যথা, জন্ডিস, খাবারে অরুচি, জ্বর। এ রকম লক্ষণ দেখা গেলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতি, লিভার ফাংশন টেস্ট, আলট্রাসনোগ্রাফি প্রভৃতি পরীক্ষা দিয়ে সহজেই বোঝা যায় রোগের উপস্থিতি ও তার মাত্রা।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন, নিরাপদ যৌন সম্পর্ক, জীবাণুমুক্ত সিরিঞ্জ ব্যবহার, স্ক্রিনিং পরীক্ষা, সময়মতো ভ্যাকসিন—এই দিয়েই রোধ করা সম্ভব হেপাটাইটিসজনিত মৃত্যু। তাই সচেতন হোন।
লেখক : রেসিডেন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।