বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হোক
আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩০৫১তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক মোজাহেরুল হক। তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা।
প্রশ্ন : বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এই বছরের প্রতিপাদ্য কী? এবং কী কী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে?
উত্তর : আমি আগে একটু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে কথা বলি। এর প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালে। এর পরে সর্বজনীন যে স্বাস্থ্য, মানে হেলথ ফর অল নিয়ে যে কথা বলা, এটি শুরু হয় আলমা আর্টার ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি দেশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যারা সিগনেচার করেছে তারা এই দায়িত্ব পালনের জন্য চেষ্টা করে। পরিসংখ্যান করে এবং পরিকল্পনা করে। প্রতি বছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিপাদ্য থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো, ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ ফর এভরিবডি, এভরি হোয়ার। মানে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রতেক্যের জন্য, সবখানে।
সারা দেশের জনপদের প্রতিটি ব্যক্তি যেন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মধ্যে থাকে, সেটি রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে।
আমরা যদি পঞ্চগড়ের কথা ধরি অথবা যদি টেকনাফ, সেন্ট মার্টিনের কথা ধরি, কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে সমান সুবিধা দিতে হবে। সেটা শহর অঞ্চলেও। তবে খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এর আগেও চেষ্টা হয়েছে। এই লক্ষ্যটা অর্জন করার জন্য আলমা আর্টার ডিক্লানেশন থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত চলে আসছে। আমাদের আগের লক্ষ্য ছিল এমডিজি। মানে মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট করব। এখন যেটার ওপর আমরা কাজ করছি সেটি হলো সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল, এসডিজি। এটা ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের অর্জন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিপাদ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্য অর্জন করতে হবে ২০৩০ এর মধ্যে। প্রত্যেকটি দেশকে, বাংলাদেশকেও।
প্রশ্ন : এমডিজি সম্পর্কে একটু বলেন? এর সঙ্গে এসডিজিতে নতুন করে কী যোগ হলো?
উত্তর : মিলিনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল একটি মিলিনিয়াম গোল ছিল। লক্ষ্যগুলোতে ঠিক করা ছিল কী কী আমরা অর্জন করব। এর মধ্যে বাংলাদেশ কিন্তু অনেক লক্ষ্য অর্জন করেছে। এরপরও কিছু অসুবিধা ছিল, আমরা কিছু পারিনি। তবে আমরা আরো ভালো অর্জন করতে পারি কীভাবে, সেই সব জিনিস নিয়ে আমাদের একটি খোরাক ছিল তখন। এখন যখন আমরা এসডিজির কথা বলছি, টার্গেট দিয়েছি ২০৩০-এ । আমাদের এখন ২০১৮। এই ১২ বছরের মধ্যে আমাদের এসডিসি লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হবে। সবগুলো লক্ষ্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নয়। সেখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়গুলো রয়েছে। স্বাস্থ্যের লক্ষ্যটা তিন নম্বর। এই তিন নম্বর লক্ষ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা এসেছে যে সবার জন্য স্বাস্থ্য। এটা নির্দিষ্ট করে স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেছে। তাহলে একে অর্জন করতে হলে আমাদের ২০৩০-এর অর্জন করতে হবে। এখন আমাদের প্রস্তুতি কী? যদি এমন একটি প্রশ্ন আসে, আমাদের স্বাস্থ্য পদ্ধতি কিন্তু ইউনিক।
প্রশ্ন : আমরা এখন কোন অবস্থায় রয়েছি?
উত্তর : এখানে আমি বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলো বলি। তাহলে আমরা বুঝতে পারবো আগামীতে আমাদের কী করতে হবে। ইতিবাচক দিক হলো বাংলাদেশের যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এটি কাঠামোগতভাবে বেশ শক্তিশালী। পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশে স্বাস্থ্য পদ্ধতি ইউনিক।
প্রশ্ন : সেটা কীভাবে? আমাদের তো দেখি অভিযোগের শেষ নেই?
উত্তর : অরগানাইজেশনাল ইনফাসট্রাকচার যদি বলি, আমাদের যেমন হাসপাতালের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, আবার আমাদের কিন্তু একেবারে প্রান্তিক অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এখন প্রশ্নটা আসছে প্রশাসনের ব্যবস্থাপনার। এই জায়গাটায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে। এই কারণে আমরা যেটা অর্জন করতে চাই সেটি অর্জন করতে পারি না। আমি একটি উদাহরণ দেই।
আমি একটি উপজেলা থেকে এসেছি। আমার এই উপজেলায় ৩২ জন চিকিৎসক থাকার কথা। আমার যে বিছানা রয়েছে, তার জন্য ৩২ জন্য চিকিৎসক যথেষ্ট। এর মধ্যে কার্ডিওলজিস্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ রয়েছে। তবে সমস্যা আমাদের যেটি হয়েছে, এই মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা প্রথম। এই যে ৩২ জন চিকিৎসক সেখানে থাকার কথা, সেখানে কতজন চিকিৎসক আসলে থাকে, এই যে একটি উপজেলার যে জনসংখ্যা, এই জনসংখ্যাকে তারা স্বাস্থ্যসেবাটা দিচ্ছে কি না। এই জায়গায় একটি অব্যবস্থপনা রয়েছে। চিকিৎসকদের আমরা দিতে পারি না। কেন? এটি প্রশানসের অকার্যকরিতা।
পাশাপাশি যে অ্যাম্বুলেন্স, এটিও প্রশাসনের বিষয়। একটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা তো সেই অ্যাম্বুলেন্সটা থাকতে হবে। ড্রাইভার রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সের যে চাকাটি রয়েছে সেটিকে উপজেলা প্রশাসক কেনার সামর্থ রাখে। তার কাছে কি সেই ফান্ড রয়েছে। এই যে কতগুলো বিষয়, এগুলো হলো প্রশাসনের বিষয়।
প্রশাসনের এসব বিষয় যদি আমরা সঠিকভাবে ধরতে পারতাম, তাহলে আমরা আরো ভালো করতে পারতাম।
প্রশ্ন : এই ১২ বছরের মধ্যে আমরা যদি এসডিজিগুলো অর্জন করতে চাই, তাহলে কী করণীয়?
উত্তর : তাহলে আমি প্রথমেই বলব, এই কাজটা করতে হবে বাংলাদেশে, যে সেটআপ রয়েছে একে কার্যকর করতে হবে। আমার একটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, তবে সেটি চালু থাকতে হবে। আমার ৩২ জন চিকিৎসক রয়েছে, তাদের সেখানে অবস্থান করে চিকিৎসা দিতে হবে।
এরপর আমাদের দেশে কয়েকটি জিনিস আনতে হবে যেটি পাশের দেশে রয়েছে। আমি দু একটি উদাহরণ দেই, তাহলে আপনার জন্য পরিষ্কার হবে, সেটি হলো নেপালের মতো দেশ, একটি ক্যানসারের রোগী যখন যাচ্ছে তখন সেই রোগীর জন্য সরকার থেকে পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। একজন নবজাতক যদি ভাল্ভের কোনো সমস্যা নিয়ে জন্মায়, তাহলে এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে যায়, অস্ত্রোপচার করে ঠিক করবে।
প্রশ্ন : সেই ক্ষেত্রে কি হেলথ ইনসুরেন্সের দিকে যাওয়া যায়?
উত্তর : আমি সেই কথাতেই আসছি। কিছু প্রণোদনা দিয়ে এরপর আমি ইনসুরেন্সের দিকে আসছি। তৃতীয় হলো কিডনি ডায়ালাইসিস। নেপালে সেটি ফ্রি। এরপর তার যেটা করতে যাচ্ছে সেটা হলো তারা সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে যাচ্ছে। এটা বললাম নেপালের কথা।
আমার পাশে ভারতের কথা যদি ধরি, তাদের এবারের স্বাস্থ্য বাজেট যদি দেখি, সেখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তারা যেই কাজটি করেছে প্রতি ব্যক্তির জন্য স্বাস্থ্য বাজেট নির্ধারিত করে দেওয়া রয়েছে। সারা বছরে তার যে স্বাস্থ্যব্যয় হবে সেটি বিমা থেকে যাবে। এরপর একজন বয়স্ক ব্যক্তি যিনি প্রবীণ, তার তো স্বাস্থ্য সুবিধা দরকার রয়েছে, তাদের জন্য ১৫ লাখ টাকা একটি ফিক্স ডিপোজিট থাকবে। এবং তারা স্বাস্থ্যবিমা চালু করছে।