কোন লক্ষণগুলো দেখলে গর্ভাব্স্থায় দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
গর্ভাবস্থায় কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় থাকে। তবে শুরু থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ঝুঁকিগুলো এড়ানো যায়। আজ ১৮ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৫৫তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি এন্ড অবস বিভাগের অধ্যাপক ডা. কিশোয়ারা সুলতানা।
urgentPhoto
প্রশ্ন : ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আসলে একটা মেয়ের জীবনে গর্ভাবস্থাই একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। তার ওপর কিছু কিছু বিষয় রয়েছে এটা যদি গর্ভবতী মায়েদের বেশি থাকে তখন তাকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা’ বলি। তার মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস। যদি উচ্চরক্তচাপ থাকে এ সময় সেটিও ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অথবা উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার পর রক্তচাপ বেড়ে গেল এই সময়। তারপর যাদের বারবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথবা জমজ বাচ্চা যদি থাকে পেটে -এগুলো হলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ।
প্রশ্ন : যখন এই জাতীয় সমস্যা হয়, তখন একজন মায়ের জন্য আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : আসলে এই সমস্ত সমস্যা মা নিজে তো বের করতে পারে না। এগুলো আমরা তখনই ধরতে পারি যখন একজন মা নিয়মিত আমাদের কাছে চেকআপে আসে। অথবা খুব জটিল একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে সে যায়, খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই সে আমাদের কাছে আসে। গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে যদি উচ্চ রক্তচাপ বেশি থাকে, সেই সব ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে রোগীকে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিই। এবং আরো কিছু পরামর্শের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনার চেষ্টা করি। যদি না হয়, তখন তো আমাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
প্রশ্ন : যাঁরা এ ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা কীভাবে বুঝবেন তাদের সমস্যা হয়েছে? এবং উপসর্গগুলো এ ক্ষেত্রে কী হবে?
উত্তর : আসলে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়, গর্ভবতী মায়েরা এটা বুঝতে পারবে যদি প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে। যেটা সহজে যাচ্ছে না। এরপর তাঁদের ঘুম হচ্ছে না –এই বড় অভিযোগ নিয়ে তাঁরা আসেন। এরপর বলতে পারে তাদের বুকের মধ্যে চাপ ধরা ব্যথা হচ্ছে। অথবা ওপরের পেটে ব্যথা হচ্ছে। অথবা কিছু কিছু মা বলে আমার বাচ্চা ঠিকমতো বাড়ছে না বা বাচ্চা পেটে নড়ছে না। এগুলো সবই একজন মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হতে পারে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে করণীয় কী? ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রেও করণীয় কী থাকে?
উত্তর : ডায়াবেটিসে আমরা ইনসুলিন দিই। প্রথমত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সাধারণত গর্ভাবস্থায় যদি ডায়াবেটিস ধরা পড়ে আমরা সরাসরি ইনসুলিনে চলে যাই। এবং সেটা রক্তে যদি অল্প পরিমাণও থাকে এতেও আমরা ইনসুলিন দিয়ে থাকি। কারণ ডায়াবেটিসে নানা রকম সমস্যা হয়। যেটার প্রভাব পড়ে বাচ্চার ওপরে। বাচ্চা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। তা ছাড়া মায়ের নিজেরও অনেক সমস্যা হয়ে যায়। সে জন্য আমরা শুধু নিজেরা নই, মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মিলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
প্রশ্ন : সন্তান প্রসবের পরে কি ডায়াবেটিস চলে যায়। আপনারা কী বলেন?
উত্তর : আসলে জন্মের পরপর দেখা যায়, মায়ের ডায়াবেটিস কমে গেছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় ডায়াবেটিস রয়ে যায়। গর্ভাবস্থায় যাঁদের রক্তে উচ্চ রক্তচাপ থাকে, প্রস্রাব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা নেমে যায়। তাঁর আর ডায়াবেটিস থাকে না। রক্তে শর্করা বেশি থাকে না।
প্রশ্ন : এর প্রভাব কি শিশুর ওপর পড়ে?
উত্তর : হ্যাঁ, তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়ে বলেই এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। জন্মগত ত্রুটি থাকতে পারে। বাচ্চাটা অনেক বেশি বড় হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ করে পেটের মধ্যে বাচ্চার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এবং পেটের মধ্যে মারাও যেতে পারে। এ ধরনের সমস্যা ডায়াবেটিস থাকা মায়েদের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়। তবে আশার কথা যে, যেহেতু ইনসুলিনের মাধ্যমে আমরা এই ডায়াবেটিস খুব ভালো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সে জন্য আজকাল এটা খুব কম হয়। যদি সচেতন না থাকেন তাঁদের বেলায় এই সমস্যা হবে।
প্রশ্ন : ইদানীং দেখা যায়, একজন মায়ের ক্ষেত্রে হয়তো বারবার এবরশন হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সেই মা যখন আবার গর্ভধারণ করছেন, তখন তাঁর একটি ভয় কাজ করে। তাঁদের ক্ষেত্রে করণীয় কী থাকে?
উত্তর : যাঁদের বারবার এবরশন হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা এই সময়টায় আমাদের কাছে আসে এবং আমরা তাদের বলি পরবর্তী গর্ভধারণ হওয়ার আগে যেন তাঁরা কিছু পরীক্ষা করেন। এবরশন হওয়ার কারণ আগে আমাদের বের করতে হবে।
প্রশ্ন : কারণ কী হতে পারে?
উত্তর : তাঁর নিজস্ব কোনো রোগ থাকতে পারে। কিছু সংক্রমণ আছে সে কারণে তাঁর এই সমস্যা হতে পারে। এরপর যদি তাঁর জরায়ুর মধ্যে কোনো সমস্যা থাকে, সে কারণেও বারবার এবরশন হয়ে যেতে পারে। এটা গর্ভধারণের আগেই করতে হয়। গর্ভধারণ করে ফেললে পরীক্ষাগুলো করা কঠিন হয়ে যায়। আগে থেকে নির্ণয় হলে তিনি নিশ্চিত হবেন। এরপর তিনি গর্ভধারণ করবেন।
প্রশ্ন : গর্ভাবস্থায় কী কী ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্ন বা লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখা মাত্র গর্ভবতী বা তাঁর আশপাশের লোকজন সতর্ক হবে?
উত্তর : আসলে পাঁচটি বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। যদি গর্ভাবস্থায় কারো হঠাৎ রক্তপাত শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পার্শ্ববর্তী চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করবেন বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে যাবেন। তারপর যদি ব্যথা ওঠে, প্রসবের সময় চলে আসছে। তবে তাঁর হয়তো অনেক সময় পার হয়ে গেল, ১২ ঘণ্টার মতো। তবুও বাচ্চা হচ্ছে না। এ রকম হলে সে চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করবে। এখন আশার কথা যে গ্রামেও অনেক হেলথ কমপ্লেক্স আছে। ইচ্ছা করলেই তাঁরা সেখানে চলে যেতে পারেন। তবে মুরুব্বিদের ভয়ে হয়তো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে চান না। তবে যদি প্রসবের ব্যথা ওঠে এবং ১২ ঘণ্টা যদি পার হয়ে যায় অবশ্যই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়া উচিত।
এরপর গর্ভাবস্থায় যদি যেকোনো সময় চোখে ঝাঁপসা দেখেন, তাঁর প্রচণ্ড মাথাব্যথা অথবা খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়, যেটা রক্তচাপ বেশি থাকলে হয়, তখন তিনি চিকিৎসকের কাছে যাবেন। তাছাড়া যদি প্রসবের ব্যথা উঠেছে দেখা গেল শিশুর মাথা ছাড়া শরীরের যেকোনো অংশ, হাত বা পা বের হয়ে আসছে- সেটাও একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। তবে এসব কিছুই এড়ানো যায় যদি আগে থেকেই একজন মা আমাদের কাছে নিয়মিত আসেন।