টানা বসে থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে গেল বিশ্ব হার্ট দিবস। তাই এ বিষয়ে আমাদের আজকের আলোচনা হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় কী? আজ ২ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম এ বাকী।
প্রশ্ন: বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার। সে হিসেবে এ বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়েছে। হার্ট নিয়ে এ রকম একটি দিবস পালনের উদ্দেশ্য কী? এবং এবার এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য কী ছিল?
উত্তর : আপনি জানেন সারা বিশ্বে যেসব মৃত্যু হচ্ছে তার শতকরা ৩০ ভাগ রক্তনালির ব্লকের কারণে। সেটা হার্ট হতে পারে বা মস্তিষ্ক হতে পারে। আমাদের ভাষায় একে বলি, সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিস। সংক্ষেপে সিভিডি বলতে পারি। একটা হয়, মস্তিষ্কের রক্তনালি ব্লক হয়ে স্ট্রোক হয়। আরেকটি হয়, হার্টের রক্তনালি ব্লক হয়ে সমস্যা। সারা বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ মৃত্যু এ দুটো রোগের জটিলতার কারণে হয়। ২০০৫ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা পৃথিবীতে এক কোটি ৭৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে কেবল এই রোগের কারণে।
তবে এই রোগ যেহেতু অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য, তাই সব হার্ট ফেডারেশন প্রতিবছর সব দেশে এই দিবস পালন করার চেষ্টা করে। জনগণকে সচেতন করার জন্য, যে কীভাবে আগে থেকেই হৃদরোগকে প্রতিরোধ করার মানসিকতা গড়ে তোলা যায়।
প্রশ্ন: এ বছর এই সচেতনতা সৃষ্টির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী ছিল?
উত্তর : ইংরেজিতে বলা হচ্ছে, ক্রিয়েট হার্ট হেলদি এনভায়রনমেন্ট। যেখানেই বসবাস করি না কেন, আসুন হার্টবান্ধব পরিবেশ গঠন করি।
প্রশ্ন : সেই পরিবেশগুলো কী?
উত্তর : হার্টের যে রক্তনালি ব্লক হয়, এর পেছনে কতগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল (অধিক চর্বিযুক্ত খাবারের প্রাধান্য), ব্যায়ামের অভাব-এগুলোকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমরা যারা বাইরে কাজ করি, তারা অনেক সময় বাড়ির বাইরে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা অবস্থান করি। বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্রে আমরা যদি ধূমপান না করি, সেটা হার্টবান্ধব পরিবেশ হবে। এখন বলতে পারেন, আমি তো ধূমপান করি না তাহলে কেন সমস্যা হবে? পেসিভ ধূমপান বা পরোক্ষ ধূমপান বলে একটি কথা আছে, তাই যে ধূমপান করে তার ধোঁয়া আপনারও সমান ক্ষতি করে। এটা চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলে। তাই সিগারেট যাতে আপনার পরিবেশে কেউ না খায় সে ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা হৃদবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির একটা পদক্ষেপ।
প্রশ্ন : এর মানে কি যারা এ দিবসটি নিয়ে কাজ করছে, তারা বোঝাতে চেয়েছে আমাদের কাজের জায়গাগুলো ধূমপান মুক্ত হতে হবে?
উত্তর : অবশ্যই। অন্তত চেষ্টা করতে হবে। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর চিকিৎসা নেওয়া তো ভিন্ন জিনিস। তবে অ্যাটাক হওয়ার আগে আপনি যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন সেটা অনেক ভালো হবে। কারণ হার্ট অ্যাটাক একবার হয়ে গেলে হার্ট আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না।
অনেক সময় রোগী বাইপাস করলে বা রিং পরলে বলে জিজ্ঞেস করে থাকে, ১০০ ভাগ গ্যারান্টি আছে কি না হার্ট ভালো হওয়ার? আমরা তখন একটু চুপ থাকি। কারণ ১০০ ভাগ ভালো হওয়া যায় না। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর হার্টের যখন মাংসপেশিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটা আর ফিরে আসে না। আমরা বাইপাস করি বা রিং পরাই। তবে এর উদ্দেশ্য হলো যেটুকু আছে সেটি অক্ষত রাখার জন্য চেষ্টা করা।
প্রশ্ন : আচ্ছা, একটা তো হলো ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। আর বিষয়গুলো কী?
উত্তর : আরো রয়েছে। যেমন : খাদ্যাভ্যাস। আমরা যেখানে যাই, খাই না কেন, সেই খাওয়াটা যেন হৃদরোগ প্রতিরোধী হয়, সে ব্যাপারটি চিন্তা করা। আপনি জানেন চর্বিযুক্ত খাবার, বেশি তেলের খাবার, জাংকফুড - এগুলো বেশি খাওয়া হয় এখন। আমাদের সভ্যতার উন্নয়নের কারণে ধীরে ধীরে এসব খাওয়ার দিকে ঝুঁকছি। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে এগুলো হার্টের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আপনি তো একদিন করে করে বছরের পর বছর খাচ্ছেন। এতে শরীরে যে কোলেস্টেরল বাড়ছে তা রক্তনালি ব্লক করে একসময় হার্ট অ্যাটাকের পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। সে জন্য আমরা যদি সচেতন হই, খাদ্যাভ্যাস যদি পরিবর্তন করি তাহলে ভালো হয়। খাবার যেন অবশ্যই হৃদবান্ধব হয়। চর্বিযুক্ত খাবার অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে।
আরেকটি বিষয়, আপনি জানেন যে দৈহিক ব্যায়াম না করা, হার্টের রক্তনালি ব্লক হওয়ার অন্যতম কারণ। আমরা অনেক সময় কাজের কারণে দীর্ঘ সময় বসে থাকি। ব্যায়াম করার সময় পাই না। এখানে বলা হয়েছে, সেসব অফিসে লিফট আছে, আমরা চেষ্টা করি, এটা বর্জন করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে। হেঁটে ওঠা নামা করতে। সেখানেও একধরনের ব্যায়াম হয়। আরেকটি বিষয় হলো যাঁরা একই জায়গায় বসে কাজ করেন, তাঁরা যেন মাঝে মাঝে উঠে একটু হাঁটাচলা করি। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার জন্য হার্টের রক্তনালি, পায়ের রক্তনালি ব্ন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকেও একধরনের জটিলতার তৈরি হয়। তাই একটু অভ্যাস যেন করি, দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে ওই জায়গাটিতেই যেন একটু হাঁটাহাঁটি করি।
এই পরিবেশ কেবল অফিসের জন্য বলছি না। বাড়িতেও যেন এই বিষয়গুলো মেনে চলি। ধূমপানমুক্ত রাখা, খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখা – এগুলোতে যেন সচেতন হই। কারণ বাড়ির ছোট বাচ্চাটিকে আমরাই খাবার খাওয়াই। আজকে থেকে সে যদি ফ্যাটি ফুড-এর আসক্ত হয়ে যায়, সে যখন বড় হবে তখন ধীরে ধীরে রক্তনালিতে ব্লকেজ হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি বিষয় বলেছে, ২০২০ সাল বাংলাদেশে হৃদরোগ মহামারী আকারে দেখা দেবে। এবং এখনো বাংলাদেশে হার্টের কারণে মৃত্যু প্রায় এক নম্বরে চলে এসেছে।
প্রশ্ন : হৃদবান্ধব পরিবেশ গঠনের কথা জানলাম, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে। এর বাইরে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এ রকম আর কী বিষয়গুলো আছে। যেমন ডায়াবেটিস, অন্যান্য রোগ বা খাদ্যাভ্যাস। যদি একটু বলেন...
উত্তর : হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায় অনেকখানি। এ জন্য নিজের সচেতন থাকতে হবে। আমরা অনেকেই কখনো রুটিন চেকআপে যাই না। আপনি জানেন উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস হার্টের রক্তনালি ব্লক হওয়ার জন্য অন্যরকম একটি ঝুঁকির কারণ। তার সঙ্গে যদি যোগ হয় ধূমপান। আমরা সচেতনতার অভাবে নিয়ম করে রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস পরীক্ষা করি না। ৫০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ এবং ৫০ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রথম দিকে কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। সে জন্য প্রত্যেকের উচিত নিয়মিত চেকআপ করা এবং চিকিৎসক দেখানো।