আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর বিকলাঙ্গতার চিকিৎসায়
আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর কখনো কখনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিকলাঙ্গতার সমস্যা হয়। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতির আশঙ্কা আরো বেড়ে যায়। আজ ৬ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. শহীদুল বারি।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আগুনে পুড়ে যাওয়ার রোগী কতখানি বেড়েছে এবং আপনাদের কাছে কেমন সংখ্যক রোগী আসছে?
উত্তর : দেখা যায় শীতকালে বাংলাদেশে এই দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। সবকিছু শুষ্ক হয়ে যায়। মানুষ আগুনের তাপ নিয়ে গরম হতে যায়। এই সংখ্যা শীতকালে বেশি থাকে। গরমের সময় এটা কম থাকে। আবার গরমের সময় অন্য ধরনের পোড়া হয়। একটি হচ্ছে ইলেকট্রিক বার্ন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্ঘটনা। এ ছাড়া কিছু সড়ক দুর্ঘটনাতেও পুড়ে যায়। এগুলো এই সময়ে বেশি হয়। শীতকালে আবার আগুন থেকে পোড়াগুলো বেশি হয়। অথবা গরম পানিতে পুড়ে যাওয়া এই ঘটনাগুলো শীতকালে বেশি হয়।
আর গত কয়েক মাস আগে রাজনৈতিক কারণে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই অযাচিত কিছু ঘটনায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। সেটা হলো পেট্রলবোমায় আক্রান্ত হয়ে। তবে এটা স্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়েছে।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ের যে জটিলতা হয় সেটি বলতে কী বুঝি?
উত্তর : আগুনে পোড়ার পর যখন চিকিৎসাগুলো চলতে থাকে, যখন রোগীটা ভালো হয়ে গেল বা বেঁচে গেল তার পরবর্তীকালে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। সে জটিলতার একটি হলো পোস্ট বার্ন কনট্রাকচার।
প্রশ্ন : যারা বেঁচে যায় তাদের ক্ষেত্রে কী কী ধরনের জটিলতা হয়?
উত্তর : একটা হচ্ছে ত্বক ফুলে যায়। হাইপার টপিক স্কার বলি আমরা। আরেক ধরনের স্কার হয় যাকে আমরা বলি কিলয়েড। এটা খুব যন্ত্রণাদায়ক। স্কারটা কিছু শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। বাড়তেই থাকে এবং খুব চুলকানি হয়। ব্যথা করে। এটা ছয় মাস পর থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাইপার টপিক স্কারেরই একটি চলমান প্রক্রিয়া এটা।
দ্বিতীয় হলো, কনট্রাকচার। এটা হলো, শারীরিক কিছু ক্ষতি হয় যেটা স্বাভাবিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো এগুলোকে বিকৃত করে দেয়। এবং তার কাজকর্ম করার যে সক্ষমতা তা নষ্ট করে দেয়।
যেমন, হাত বাঁকা হয়ে গেল। অথবা ঠোঁট মুখের একদিকে বেঁকে গেল। কনট্রাকচার হওয়ার পর দেখা যায় সে হয়তো চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছে না। চোখটা খোলা থাকে। এ অবস্থায় চোখে ঘা হয়ে যায়। পা-ও একইভাবে শক্ত হয়ে যায়। চোখের ক্ষেত্রে আমরা একে বলি এট্রোপিয়া। আর হাত-পায়ে যেটা হয় একে বলি কনট্রাকচার।
প্রশ্ন : এই ধরনের জটিলতাগুলো প্রতিরোধের কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : আসলে প্রতিরোধটা শুরুতেই শুরু করতে হবে। আমরা যদি চিন্তা করি রোগীটির এই জটিলতাগুলো হতে পারে। তাহলে যখন আমরা পোড়ার চিকিৎসা করি এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। এই বিষয়টি অনেকটাই বর্তায় চিকিৎসকের ওপর। তবে এর একটি কথা রয়েছে পোড়ার চিকিৎসা কেবল চিকিৎসকরা করে না। একে বলা হয় দলের কাজ। যেমন, প্লাস্টিক সার্জন থাকবেন, বার্ন সার্জন, ফিজিওথেরাপিস্ট থাকবেন, অকোপেশনাল থেরাপিস্ট থাকবেন, সাইকিয়াট্রিস্ট থাকবেন। এটা একটা দলের কাজ। এবং নার্সের সেবার কাজটিও ভালো হতে হবে। প্রতিদিন রোগীকে কয়েকবার করে ফিজিওথেরাপি দিতে হবে। যাতে গাঁটগুলো শক্ত না হয়ে যায়।
রোগী যখন ঘুমায়, তখন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বাঁকা হতে থাকে। এটা যাতে না হয় এর জন্য বাকি সময়ে স্প্লিন ব্যবহার করব। যাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্বাভাবিক থাকে সেভাবে রাখার জন্য। পা ৪৫ ডিগ্রি করে রাখব। গোড়ালিকে ৯০ ডিগ্রিতে রাখব। এর উদ্দেশ্য হলো, যখন আমি ফিজিওথেরাপি দেব, সেটা খুলে দেব। বাকি সময়ে আমি সেটা দিয়ে রাখব, যেন ঘা বেঁকে না যায়। তাহলে আমরা সহজেই এই বিকৃতিগুলোকে অনেকখানি ঠিক করতে পারব। তবে এখানে একটি সমস্যা আছে। এ ধরনের চিকিৎসা করতে হলে প্রচুর জনশক্তি দরকার।
প্রশ্ন : সেটি আমাদের দেশে আছে কি?
উত্তর : এখানেই সমস্যা। আপনি দেখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথমে ছিল ৫০ বেড। রোগী থাকত ৪০০। এখন বেড ১০০, তবে রোগী থাকে ৫০০-এর উপরে। সেই তুলনায় যে পরিমাণ চিকিৎসক এবং নার্স থাকার কথা, তার এক-চতুর্থাংশও নেই। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে আমাদের ই্উনিটে ৩০টি বেড রয়েছে। ৩০টি বেড ভর্তি হয়েও অন্য জায়গা থেকে ধার নিয়েও আমরা কুলাতে পারতাম না। তবে আমাদের যে পরিমাণ দক্ষ নার্স দরকার, তা নেই। যেমন ধরেন ফিজিওথেরাপি। সেখানে ফিজিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে তবে জনবল কম। একজন ফিজিও থেরাপিস্ট সারা দিনে হয়তো তিনটি বা চারটি রোগীর সেবা দিতে পারেন। আর বড় ধরনের পোড়া হলে একজন নার্সকে সার্বক্ষণিক একজন রোগীর সঙ্গে থাকতে হয়। সারা দিনে তিনজন নার্স লাগবে। আধা ঘণ্টা ডিউটি করবে। তবে আমাদের দেশে কি এটা সম্ভব? এই সুবিধাটুকু আনতে হবে।
প্রশ্ন : যখন বিকলাঙ্গতায় রূপ নিয়ে নিয়েছে, তখন আপনারা নিরাময়ে কী করেন?
উত্তর : এটা নির্ভর করে কোন জায়গায় বিকৃতি হয়েছে তার ওপর। চোখের পাতায় যদি সমস্যা হয়, তখন এটাকে সরিয়ে দিতে হবে। এরপর অন্য জায়গা থেকে ত্বক নিয়ে এসে ওখানে বসিয়ে দিতে হবে। এর জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে, একে ‘কুইলটিং’ বলি। কয়েকটা দিন চোখের পাতাটা ফিক্স করে রাখতে হয়। এরপর আমরা স্বাভাবিক নড়াচড়া দিতে থাকি। যেন স্বাভাবিক নড়াচড়া দিতে থাকে। দিলে চোখের পাতাটা যখন ভালো হওয়ার দিকে আসবে তখন স্বাভাবিক যেভাবে থাকার কথা সেটা হবে। এটা হলো চোখের ক্ষেত্রে। তবে আবার ঠিক সময়মতো এই সেলাইগুলোকে বের করে আনতে হবে। নয়তো সেলাইগুলো একটি সমস্যার কারণ হবে। সে জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজটা করতে হবে।
এরপর আসি ঘাড়ে। এখানে যদি কনট্রাকচার হয়, তাহলে অনেকগুলো পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করার আছে। যেমন জেট প্লাস্টি অথবা ডাব্লিউ ওয়াই প্লাস্টি, ভিওয়াই প্লাস্টি এগুলো করে আমরা ঠিক করতে পারি। আর যদি বেশি হয় যে এগুলো করা যাচ্ছে না, তখন অন্য দিক থেকে ত্বক এনে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করি। যাকে বলা হয় গ্রাফটিং। তবে শুধু করলেও হবে না, সমস্যা আবার হতে পারে যদি আমি স্প্লিনটিং না দিই।
প্রশ্ন : এটি কতদিন পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়?
উত্তর : সাধারণত তিন মাস পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা হয়। তবে কখনো কখনো ছয় মাস পর্যন্ত এটি ব্যবহার করতে হয়। ঠিক একই রকমভাবে শরীরের প্রতিটি জায়গায় আলাদা আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একই কথা মনে রাখতে হবে, গ্রাপ করব বা ফ্লাপ- যাই করি না কেন রোগীকে ফিজিওথেরাপি নিতে হবে। রাতের বেলা স্প্লিনটিং নিয়মিত নিতে হবে। তবে এটা বেশি দিন নয়, এক মাস ব্যবহার করলেই রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফেরত চলে আসতে পারে।
প্রশ্ন: এই ধরনের বিকলাঙ্গতা রোধ করার চিকিৎসা কোন জায়গায় পাওয়া যাবে সেটি যদি বলতেন।
উত্তর : ঢাকা মেডিকেল কলেজ, এখানে এই সুবিধা আছে। দ্বিতীয়ত ঢাকাতেই আরেকটি আছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, এখানেও আরেকটি চমৎকার বার্ন ইউনিট রয়েছে। এটি ৩০ বেডের। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই এটি চালু করা হয়েছে।
এ ছাড়া মুগদা মেডিকেল কলেজ একটি হয়েছে, সেখানে এই সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের পাশে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল রয়েছে সেখানেও এটা হচ্ছে। এখানে একজন প্লাস্টিক সার্জন পোস্টেড হয়েছে, সে কাজ করছে। আর ঢাকার বাইরে কুমিল্লায় খুব ভালো কাজ হচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিটে বেশ ভালো কাজ করা হচ্ছে। আর রংপুর মেডিকেল কলেজে হচ্ছে। সিলেট মেডিকেল কলেজে বৃদ্ধি পাচ্ছে মোটামুটি। এর বাইরেও আছে খুলনা ও রাজশাহী, সেখানে এদের মতো এত ভালো না হলেও সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে।