হেপাটাইটিস বি ও সি রোগের চিকিৎসা কী
হেপাটাইটিস হলো লিভারের একটি প্রদাহ। এটি অনেকগুলো ভাইরাসের মাধ্যমে হয়। এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো হেপাটাইটিস বি ও সি। আজ ১৬ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৭৬তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. ফাওয়াজ হোসেন শুভ।
প্রশ্ন : লিভারের প্রদাহে হেপাটাইটিস বি ও সি-এর প্রতি আপনারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, এর কারণ কী?
উত্তর : লিভারের প্রদাহকে আমরা হেপাটাইটিস বলি। এটি অনেকগুলো ভাইরাসের মাধ্যমে হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। কারণ এগুলোর জটিলতাগুলো খুব জটিল আকার ধারণ করেছে আমাদের কাছে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নিয়ে যদি আমি প্রথমে কথা বলি, এই বি ভাইরাস দিয়ে যদি কোনো সংক্রমণ হয়ে থাকে একে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। একটি একিউট (স্বল্প মেয়াদি) হেপাটাইটিস হতে পারে। আরেকটি ক্রনিক হেপাটাইটিস (দীর্ঘ মেয়াদি) হতে পারে। যদি বি ভাইরাস কারো শরীরে ঢোকে এবং এটি ছয় মাস পর্যন্ত অবস্থান করে, তখন তাকে আমরা একিউট হেপাটাইটিস বলি। আর যদি ছয় মাসের বেশি অবস্থান করে তখন একে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলি।
একিউট হেপাটাইটিস আমরা জানতে পারি তৎক্ষণাৎ কিছু লিভারের পরীক্ষার মাধ্যমে। সেই ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বা এইচবিএসইজি যদি পজিটিভ হয় এবং সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি এইচবিসিআইজিএম নামে একটি পরীক্ষা করি সেটাও পজিটিভ হতে হয়। তার সঙ্গে লিভারের অন্যান্য এনজাইমগুলো যদি পজিটিভ হয় তাহলে বলা হয় রোগটি রয়েছে। আর এই সংক্রমণ যদি ছয় মাসের বেশি অবস্থান করে তখন তাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি বলে চিহ্নিত করি।
আমাদের কাছে অনেক সময় রোগীরা আসে, হয়তো তার কোনো লক্ষণ নেই, অন্য কোনো কারণে সে পরীক্ষা করে এসেছে, তখন ধরা পড়ে। বিশেষ করে বিদেশে যাওয়ার জন্য কিংবা রক্ত দেওয়ার জন্য কোথাও গিয়েছে তখন রুটিন স্বাস্থ্য চেকআপে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ পাওয়া যায়। এসব রোগীকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি বলে চিহ্নিত করে থাকি। এখন এই ক্রনিক হেপাটাইটিস বি দুইভাবে থাকতে পারে। অর্থাৎ অ্যাকটিভ (কার্যকর) অবস্থায় থাকতে পারে। অথবা ইনঅ্যাকটিভ ( নিষ্ক্রিয়) অবস্থায় থাকতে পারে।
এটা কার্যকর না কি অকার্যকর এটি দেখার জন্য আমরা এখন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। প্রথমত রক্তের যে পরীক্ষাগুলো করে থাকি, যেমন : হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ডিএনএ পিসি আর করি, এইচবিএসএজি কোয়ান্টিফিকেশন করে থাকি। এই পরীক্ষা ছাড়াও আমরা লিভারের কিছু পরীক্ষা করি। যেমন : সোনোগ্রাফ করি, ফাইব্রোস্ক্যান নামে নতুন একটি পরীক্ষা এসেছে, এটি করে লিভারের স্টিফনেস দেখি। অর্থাৎ ক্রনিক হেপাটাইটিস বি লিভারকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করছে সেটি আমরা দেখতে পারি ফাইব্রোস্ক্যানের মাধ্যমে।
প্রশ্ন : একজন মানুষ হেপাটাইটিস বি বা সি দ্বারা আক্রান্ত হয় কীভাবে?
উত্তর : বি অথবা সি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কারো রক্ত যদি পরীক্ষা না করে অন্য কারো শরীরে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সে এই ভাইরাসের মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারে। তবে এখন এগুলো এত উন্নত হয়েছে যে পরীক্ষা ছাড়া রক্ত দেওয়াই হয় না। তারপরও প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক সময় এটি ঠিকমতো হয় না।
অবাধ যৌনাচারের কারণে এটি হতে পারে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুই যদি অসাবধানতাবশত অন্য কাউকে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সমস্যা হতে পারে। আর দাঁতের চিকিৎসকদের কাছে যদি জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না থাকা হয়, তাহলে অনেক সময় এই বি ও সি ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। এটি যেকোনো সার্জিক্যাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে ইদানীং আমরা এটা ডেনটিসট্রি বা অন্য কোনো জায়গা থেকে বেশি পাচ্ছি।
প্রশ্ন : সেটা কি আপনারা নিশ্চিত হতে পারেন যে ডেনট্রিসট্রি থেকে আসছে?
উত্তর : আমাদের কাছে ইদানীং কিছু রোগী আসছে যারা বলে আমাদের তো কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি, কিংবা আমরা কোনো রক্ত নিইনি তাহলে কেন হয়েছে? তখন তাদের দেখা যায়, দাঁতের চিকিৎসার কোনো ইতিহাস রয়েছে। তবে এটা একটা ধারণামাত্র, নিশ্চিত বিষয় নয়। রোগী একটি সান্ত্বনা খুঁজতে চায় কীভাবে হলো। তারপর মাদকসেবী যারা রয়েছে একই সিরিঞ্জ অনেকে ব্যবহার করতে পারে। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নবজাতকের হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের কাছ থেকে আসতে পারে। সাধারণত এই কয়েকটি উপায়ে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।
প্রশ্ন : অনেক সময় এন্ডোস্কোপির জন্য যে টিউব ঢোকানো হয়, সেই টিউব যদি জীবাণুমুক্ত না করে আবার আরেকজনকে দেওয়া হয়, তাহলে সেখান থেকেও কি ছড়াতে পারে?
উত্তর : না, এ ধরনের কোনো এন্ডোস্কোপিক টিউব থেকে ছড়ানোর আশঙ্কা কম থাকে। কারণ এন্ডোস্কোপিক টিউবগুলো কোনো রক্তের সংস্পর্শে আসছে না। কিন্তু আমরা যদি অন্য কিছু করে থাকি, এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে সেই ক্ষেত্রে যদি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করা হয়, তখন একটা আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন : হেপাটাইটিস বি ও সি ছড়ানোর পদ্ধতিগুলো প্রতিরোধের উপায় কী?
উত্তর : প্রথমত আক্রান্ত না হওয়ার জন্য সচেতনতা প্রাথমিক বিষয়। আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সুই ব্যবহারের বিষয়গুলো থেকে শুরু করে মাদকসেবীদের এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে হবে। রক্ত যখন দেওয়া হয়, তার আগে যে স্ক্রিনিং হয় সেগুলো খুব ভালো হতে হবে। এরপর অস্ত্রোপচারের যন্ত্রগুলোকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে এই সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব।
এরপর আরেকটি বিষয় রয়েছে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেই যে জীবনের সবকিছু শেষ তা নয়। কারণ এই হেপাটাইটিস বি ভাইরাস যদি নিষ্ক্রিয় থেকে থাকে তাহলে আমরা চিকিৎসা দিই না। তবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস যদি সক্রিয় থাকে, ডিএনএ যদি বেশি থাকে এবং তার সাথে যদি ফাইব্রোস্ক্যান, সিরাম অ্যালবুমিন যদি কোনো পরিবর্তন এসে থাকে, তখন হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের চিকিৎসা নিলে একটি নিরাপদ অবস্থানে থাকা যায়। রোগীকে সুস্থ রাখা যায়।
প্রশ্ন : হেপাটাইস বি বা সি ভাইরাস নিরাময়যোগ্য কি না?
উত্তর : এই নিয়ে আসলে এই মুহূর্তে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারণ বিশ্বে এখন হেপাটাইটিসের চিকিৎসা এত উন্নত হয়ে গেছে যে বি ও সি ভাইরাসের বেশ ভালো ব্যবস্থাপনা চলে এসেছে। এবং আমাদের দেশেই এর খুব ভালো ব্যবস্থাপনা সম্ভব। বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে অনেক ভালো ওষুধ দিচ্ছি। সি ভাইরাসের ক্ষেত্রে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে এখানে।
সি ভাইরাসে যদি পেটে পানি চলে আসে, অথবা গলার মধ্যে রক্তনালিগুলো ফুলে যায় সে ক্ষেত্রে সফোসফবি দিয়ে চিকিৎসা করলে রোগী অনেক ভালো থাকে। এখন বিশ্বমানের চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব এবং ভালো চিকিৎসা রয়েছে। আশ্চর্য হবেন জানলে যেহেতু সি ভাইরাসের ওষুধের দাম আমাদের দেশে কম, তাই বাইরের দেশের লোকেরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসছে।
প্রশ্ন : ওষুধের খরচ কেমন? বিশেষ করে হেপাটাইটিস সি-র বিষয়ে?
উত্তর : সি-র বিষয়ে খরচ এখন অনেক কমে গেছে। কারণ আমরা এখন যেভাবে চিকিৎসা দিয়ে থাকি, এতে খরচ খুব কম। ছয়টি জেনোটাইট আছে, আমরা যদি তিন থেকে ছয় মাস চিকিৎসা দিয়ে থাকি, এতে এক থেকে দেড় লাখ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে না। আগে অন্য ওষুধ দিয়ে যে চিকিৎসা করা হতো, এটির খরচ অনেক বেশি ছিল। হেপাটাইটিস সি-র চিকিৎসায় এটি একটি বড় অগ্রগতি।