রোগের লক্ষণ দেখা যায় মুখে
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোগের লক্ষণ মুখে দেখা দিতে পারে। আবার মুখের রোগের কারণেও শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ বিষয়ে সচেতন থেকে সঠিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। আজ ১৮ অক্টোবর, এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২১৭৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞ ডেন্টাল সার্জন ডা. আশরাফুজ্জোহা রাজ।
urgentPhoto
প্রশ্ন : অনেকেই মুখের মধ্যে যখন কোনো জটিলতা হয়, তখন ডেন্টাল সার্জনের কাছে আসেন। আবার শরীরের অন্যান্য জায়গায় কোনো রোগ বা লক্ষণ দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। তবে এ দুটো বিষয়ই যোগসাজশপূর্ণ। আপনি বলবেন কি, একজন মানুষের মুখের মধ্যে কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যার উৎস আসলে মুখে নয় শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে?
উত্তর : আমাদের অনেকের মুখে দুর্গন্ধ হয়। দেখা যায়, ঠিকমতো দাঁত ব্রাশ করছে, মুখে কোনো জীবাণু নেই, মুখের স্বাস্থ্য খুব ভালো, এর পরও মুখে গন্ধ। এই গন্ধের কারণ হিসেবে কিছু সিস্টেমিক (পদ্ধতিগত) বিষয় থাকতে পারে। যেমন : আমাদের লিম্ফোয়েডে যদি কোনো সমস্যা থাকে, মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। যদি কারো অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, তবে নিশ্বাসের সঙ্গে দুর্গন্ধ আসতে পারে। কিডনির সমস্যা হলেও মুখের ভেতর গন্ধ হতে পারে। গ্যাসটোইনটেসটাইনাল সমস্যার জন্য হতে পারে।
প্রশ্ন : আর কী সমস্যা মুখে আসতে পারে?
উত্তর : অনেক সময় দেখা যায়, ব্রাশ করার পর মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছে। দেখা যায়, এই রক্তের কারণ মুখের কিছু নয়, আসলে শরীরের অন্য কোনো সমস্যার কারণেই এটি হচ্ছে।
তার পরে লিভারের কথা বলি। আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্ত যখন জমাট বেঁধে যায়, এই জমাট বাঁধায় ক্লটিং ফ্যাক্টর কাজ করে। এই ক্লটিং ফ্যাক্টের অনেকটাই আমাদের লিভারে তৈরি হয়। দেখা যায়, লিভারে সমস্যা থাকলে এই ক্লটিং ফ্যাক্টর কাজ করে না। ফলে কেবল মাড়ি থেকেই নয়, শরীরের অন্য কোথাও কেটে গেলেও রক্ত পড়া সহজে বন্ধ হতে চায় না। আবার অনেক সময় ব্লাড ক্যানসারের কারণেও মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। কিছু ভিটামিনের ঘাটতির কারণে হতে পারে। যেমন : ভিটামিন-সির অভাব হলে মাড়ি দিয়ে রক্ত ঝরতে পারে। ভিটামিন-কের অভাব হলেও এমন হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলেও এমন হতে পারে। ডেঙ্গু হলে রক্তের মধ্যে প্লেটলেট উপাদানটি কমে যায়। এর জন্য রক্ত জমাট বাঁধবে না এবং রক্ত পড়বে।
প্রশ্ন : এ ছাড়া মুখের মধ্যে জ্বালাপোড়া, ঘা হওয়া, সাদা আবরণ পড়া সেটিও হতে দেখি। এটিও কি পদ্ধতিগত কারণে হতে পারে?
উত্তর : এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কারণের জন্যই হয়। যেমন মুখের প্রচলিত যে ঘায়ের কথা বলে থাকি, সেটা হলো অ্যাসথাস আলসার। আমাদের মধ্যে অনেকেরই হয়। এটি একবার তৈরি হলে হয়তো চার থেকে সাত দিন পর্যন্ত থাকে। এর পর চলে যায়। এটা বেশ ব্যথাদায়ক ঘা। মুখের যেকোনো জায়গায় হতে পারে। একে আমরা অটোইমিউন রোগ বলি। এটি একটি ঝঁকিপূর্ণ কারণ। যেমন বেশি রাত জাগলে, বেশি ঝালযুক্ত খাবার খেলে বা কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এদের হয়তো মুখের মধ্যে ঘা হতে পারে। অতিরিক্ত চিন্তায় থাকলেও এটি হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে হরমোনের কারণেও হতে পারে।
প্রশ্ন : দেখা যায়, নারীদের ক্ষেত্রে একটু বয়স্কদের বানিং মাউথ সিনড্রোম হয়। এই বিষয়টি কী?
উত্তর : একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর নারীদের শরীর মেনোপজাল অবস্থায় আসে। হরমোন পরিবর্তনের কারণে মুখের মধ্যে এই জ্বালাপোড়া ভাবটি আসে। এ ছাড়া ভিটামিন-ডির অভাবে এমন হতে পারে। কিছু মিনারেলের অভাবেও মুখে এ ধরনের জ্বালাপোড়া তৈরি হতে পারে।
প্রশ্ন : মুখের মধ্যে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন তো রোগী মুখের চিকিৎসকের কাছেই আসবেন। আসার পর করণীয় কী? কারণ, এর উৎস তো মুখে নয়। তখন আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : প্রথমেই একজন ডেন্টাল সার্জন আগে মুখের অবস্থাটা দেখে নেবে যে কারণটি আসলে দাঁতের কারণে হচ্ছে কি না। যদি না থাকে, তবে কিছু ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার দরকার হতে পারে। সেটা রক্তের পরীক্ষা হোক বা এক্স-রে হোক—এ ধরনের কিছু প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার দরকার হতে পারে। পরীক্ষা করে বুঝে নিতে হবে, এটি কোন বিভাগের সমস্যা। সে অনুযায়ী চিকিৎসকের কাছে আমাদের পাঠাতে হবে।
একজন দাঁতের চিকিৎসকদের সবকিছুই জানতে হবে। মুখের সঙ্গে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিষয়টিও জড়িত। সে জন্য রোগীদের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
আপনাদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দর্শককে বলতে চাই, কিছুদিন আগে হয়তো এই আধুনিক অবস্থা ছিল না, তবে এখন বাংলাদেশ ডেন্টাল কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে ঢুকলে প্রতিটি ডাক্তারের কোয়ালফিকেশন জানা যায়।
প্রশ্ন : আলোচনাটি একটু অন্যদিকে নিতে চাই। মুখের মধ্যে সমস্যা দেখা যায়, কিন্তু সমস্যাটা শরীরের অন্য জায়গায়। এবার যদি একটু উল্টো করে দেখি, মুখের মধ্যে রোগটা আর লক্ষণগুলো শরীরের অন্য কোথাও—এটিও কি হতে পারে?
উত্তর : অবশ্যই হতে পারে। আমাদের জানতে হবে, দাঁতে যে রক্ত সংযোগ আছে, এটা সারা শরীরেই যাচ্ছে। সমস্যা শুধু দাঁতে আছে বলেই যে শরীরের অন্য কোথাও যাবে না, এটা ঠিক না। দাঁতের সঙ্গে আমাদের যে রক্তের সংযোগ, এটি আমাদের হার্টে চলে যেতে পারে। হার্টের বিভিন্ন অংশকে সংক্রমণ করতে পারে। দাঁতের সমস্যা আমাদের লিভারে যেতে পারে, কিডনিতে যেতে পারে। এমনকি আমাদের মস্তিষ্কে পর্যন্ত দাঁতের সমস্যা যেতে পারে এই রক্ত চলাচলের মাধ্যমে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে ওই রোগ হলে আসলে কী করে বোঝা যাবে দাঁতের রোগ থেকে হয়েছে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। একটি উদাহরণ দিই, ডায়াবেটিস রোগটি ঘরে ঘরে আছে, অনেকে দেখা যায়, ইনসুলিন নিচ্ছে, ওষুধ খাচ্ছে, হয়তো ঠিকমতো ব্যায়ামও করছে; কিন্তু রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। চিকিৎসা গবেষকরা এটি প্রমাণ করেছে, দাঁতের ধারক কলার সংক্রমণ যদি দীর্ঘদিন ধরে রয়ে যায়, মাড়ি ফোলা, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া—এগুলো যদি দীর্ঘদিন রয়ে যায়, তাহলে ইনসুলিন নিলেও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ হয় না। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসককে মুখের পরীক্ষা করে বুঝতে হবে অবস্থাটি কী। এখান থেকে ওই ঝুঁকির কারণগুলো চলে আসছে কি না, এইটা বোঝার প্রয়োজন হবে।
গর্ভবতী নারীদের যত্নের বিষয়ে বেশি খেয়াল করতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্তের আগে আমি বলব, মুখ একটু পরীক্ষা করে নেওয়ার। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে ইউএসএর একটি জার্নাল থেকে জানলাম, যেসব অপরিপক্ব বাচ্চা হয়, তার ১৭ শতাংশ দায়ী হলো দাঁতের সমস্যা বা মুখের রোগ। মুখের রোগ রয়ে গেলে তার থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয়। যেটা এ সময়ের আগে সমস্যার জন্য দায়ী।