কিডনি দান কারা করতে পারবেন?
কিডনি অকেজো হয়ে গেলে এর সর্বোত্তম চিকিৎসা হলো কিডনি সংযোজন বা প্রতিস্থাপন। কিডনি সংযোজন হলো একজনের কিডনি নিয়ে আরেকজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা।
তবে একজন কিডনি অকেজো হওয়া রোগী কাদের কাছ থেকে সুস্থ কিডনি নিতে পারবেন বা কারা তাঁকে কিডনি দান করতে পারবেন?
এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৩৯৮তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. হারুন অর রশিদ। বর্তমানে তিনি কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কিডনি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : কিডনি সংযোজন কী, কাদের জন্য এটি করতে হয়?
উত্তর : কিডনি সংযোজন হলো, একজনের কিডনি নিয়ে আরেকজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা। কারো শরীরে যখন দুটো কিডনিই অকেজো হয়ে যায়, তখন ওই ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিডনি সংযোজন করে তাঁকে নতুন জীবন ফিরিয়ে দেওয়া যায়। কিডনি সংযোজন দুভাবে করা যায়। একটি হলো নিকটাত্মীয়, যেমন—বাবা-মা, ভাইবোন, চাচা-মামা, ফুফু-খালা, এমনকি বাংলাদেশে চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই, নানা-নানি, দাদা-দাদি, স্বামী-স্ত্রী, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে এবং যাঁদের দুটো কিডনি সুস্থ, যাঁদের ডায়াবেটিস নেই, উচ্চ রক্তচাপ নেই, কিডনিতে কোনো অসুখ নেই, অন্যান্য অসুখেও কিডনি আক্রান্ত নয়, তাঁরা স্বাভাবিক অবস্থায় ইচ্ছা করলে তাঁর আত্মীয়কে কিডনি দিতে পারেন। এটি হলো সর্বোত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি, একজন কিডনি অকেজো রোগীর জন্য।
প্রশ্ন : এ ছাড়া আরেকটি পদ্ধতি রয়েছে কি?
উত্তর : এ ছাড়া আরেকটি পদ্ধতি রয়েছে। সেটি হলো মৃত ব্যক্তি দান করতে পারে। সে শুধু দুটো কিডনি নয়, সঙ্গে লিভার দান করতে পারে, হৃৎপিণ্ড দান করতে পারে এবং দুটো ফুসফুসও দান করতে পারে। অর্থাৎ একজন মৃত ব্যক্তি পাঁচ থেকে ছয়জন মানুষ, যাদের বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাদের বাঁচাতে পারে।
এদের বয়সও ৫ থেকে ৬৫ থাকতে হবে। এদের ক্ষেত্রে দুটো কিডনি সুস্থ থাকতে হবে, লিভার দিতে হলে এটি সুস্থ হতে হবে। হার্ট দিতে হলে এটি সুস্থ থাকতে হবে।
এখন মৃত ব্যক্তি বলতে কী বোঝায়? কোনো মানুষ যদি বাসায় মারা যায় অথবা হাসপাতালের সাধারণ বিছানায় মারা যায় অথবা সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে রাস্তাতেই মরে গেল, সেই কিডনি বা লিভার কিন্তু কাজে আসবে না। তাকে মৃত ঘোষণা করতে হবে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। যখন সে ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি হয়, তখন আমরা জানি যে তার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। শত চেষ্টা করেও যখন তাকে বাঁচাতে পারে না, তখন তার মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। কিডনি সংযোজন করতে চাইলে বা তিনি কিডনি দিতে চাইলে, আমাদের যে অর্গান অ্যাক্ট ল রয়েছে, তাতে বলা রয়েছে একজন মেডিসিনের অধ্যাপক, একজন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের অধ্যাপক অথবা একজন নিউরোলজিস্ট, এরা আলাদা আলাদাভাবে সেই ব্যক্তিকে পরীক্ষা করবে, পরীক্ষা করার পরে যখন ওই তিনজন ব্যক্তি নিশ্চিত হবে রোগীটি মারা গিয়েছে, তখন তাকে মৃত ঘোষণা করবে। মৃত ঘোষণার পর পর ওই রোগীর আত্মীয়স্বজনকে তারা বলবে, আপনার যে আত্মীয় মারা গেছে, তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অন্যান্য রোগীর শরীরে দান করতে। মৃত ব্যক্তিটি অন্য ছয়টি মানুষের দেহে বেঁচে থাকবে। এটা একটি মহৎ কাজ।
প্রশ্ন : অনেক সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। তখন তাদের আপনারা কীভাবে বোঝান?
উত্তর : আমাদের ধর্মের দিক থেকে কিন্তু কোনো অসুবিধা নেই। সৌদি আরব থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই কিন্তু মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজন করা হচ্ছে। সৌদি আরবে ১৯৮৮ সালে তাদের যে সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের ওলেমা, তিনি রায় দিয়েছেন, মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজন ইসলাম গ্রহণ করে অন্য ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য। এই জন্য আমরা মনে করি, সচেতনতার অভাবে, মানুষের বোঝার অভাবে ওই সময় ওই কাজটি রোগীর আত্মীয়স্বজন করতে চায় না। একজন অসুস্থ মানুষ মারা গেলে তার আত্মীয়স্বজন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তখন এ জন্য যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, সে তখন সেটি মেনে নিতে চায় না।
এ জন্য পরামর্শদাতা তৈরি করতে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম লাগে। সেটা একজন চিকিৎসক, নার্স বা সমাজসেবক করতে পারে। তারা ওই সময়ে বোঝালে কিন্তু দিতে রাজি হয়।
ইদানীং আমরা চেষ্টা করেছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, বারডেম আইসিও ও নিউরোসায়েন্স মেডিকেলের আইসিওতে একনাগাড়ে সাত দিন চেষ্টা করেছিলাম যে যদি মৃত ব্যক্তির কিডনি পাওয়া যায়, তাহলে আমরা অকেজো রোগীকে প্রতিস্থাপন করব। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, আমরা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে একজন রোগী পেয়েছিলাম, যিনি স্ট্রোকের কারণে ইনটেনসিভ ইউনিটে ভর্তি রয়েছে। রোগীর বয়স ছিল ৪৫ বছর। যখন তাঁকে মৃত্যু ঘোষণা করা হলো, তখন আমরা তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই কাউন্সেলিং আমরা করতে পারিনি, আমাদের দুটো রোগী তৈরি থাকা সত্ত্বেও প্রতিস্থাপন করা যায়নি। সে জন্য আমরা এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছি।