বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা কি সম্ভব?
স্তন ক্যানসার একটি আতঙ্কের নাম হলেও এটি অন্যান্য ক্যানসারের মতো জটিল নয়। প্রাথমিক অবস্থায় এর চিকিৎসা করা গেলে রোগ জটিল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আজ ৩০ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৯০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের সমন্বয়কারী ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারের সচেতনতা নিয়ে যেসব কার্যক্রম আপনারা করছেন, সেটি নিয়ে কিছু বলুন?urgentPhoto
উত্তর : খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সারা পৃথিবীতে তো মানুষ এখন স্তন ক্যানসার নিয়ে অনেক সচেতন। পশ্চিমা দেশগুলোতে তারা অনুষ্ঠান করে। আমি তো ক্যানসার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে রয়েছি ২২ বছর ধরে। ২০০৫ সালে একটি অনুষ্ঠান হয় স্তন ক্যানসার সেবা সপ্তাহ নামে। বাংলাদেশ ক্যানসার ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান সেটির আয়োজন করে। তবে এর আগে একাধিক সংগঠন বছরে একটি বা দুটি এ রকম অনুষ্ঠান পালন করত। এর পর আমরা ‘থিংক পিংক’ নামে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করলাম। একটি গোলাপি ফিতা, যেটি স্তন ক্যানসার সচেতনতার একটি চিহ্ন। এই থিংক পিংক নামের ক্যাম্পেইনটা আমরা খুব জোরালোভাবে শুরু করলাম। ঢাকা শহরে অনেক শিক্ষিত নারী সংকোচের কারণে হোক বা যেকোনো কারণে হোক, ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে আসেন না। হাসপাতালে আমরা দেখি, এরা অনেক দেরিতে আসছেন। আমরা মনে করলাম, তাদেরও সচেতন করা জরুরি। কারণ, সচেতনতা বলতে অনেক কিছু বোঝায়। এখানে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সে কথাও বলা দরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করলে রোগ মুক্তি করা যায়, সেটিও বলতে হবে। আবার চিকিৎসা নিয়েও ভুল ধারণা আছে। সেগুলো ভেঙে দেওয়া দরকার। এসব কিছু মিলিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। এসব নিয়ে আমরা চিন্তা করলাম। এর পর কয়েক বছর পার হওয়ার পর আমরা দেখলাম, ২০০৯ সালের দিকে কয়েকটি সংগঠন অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠান করছে। এভাবে চলছিল। হঠাৎ করে ২০১৩ সালে মনে হলো, একটি দিনকে আমরা সচেতনতা দিবস হিসেবে ঠিক করি। প্রথমে আইসিডিডিআরবির কাছে গেলাম। এরপর যারা ক্যানসার নিয়ে কাজ করে, এ রকম ছোট-বড় সংগঠনকে বললাম। তারা সবাই একে স্বাগত জানাল। এর পর আমরা ১০ অক্টোবরকে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করার চিন্তা করলাম। এটা কোনো সরকারি ঘোষণা নয়। তবে আমরা জানি, আমরা যদি একে চালু করতে পারি, তবে একসময় অবশ্যই সরকার বিষয়টি আমলে নেবে।
প্রশ্ন : এই দিনটি সামনে নিয়ে কী করছেন?
উত্তর : এই দিনটি সামনে নিয়ে আমরা যে কাজটি করছি সেটি হলো, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকির কারণগুলো কী? এটি কেন হয়? এবং কীভাবে আমরা নিজে নিজে পরীক্ষা করতে পারি বা নিজের সন্দেহ হলে আমরা কোথায় যাব, কোন চিকিৎসকের কাছে যাব? কী কী পদ্ধতি আছে পরীক্ষা করার? এগুলো নিয়ে ডায়াগ্রামসহ একটি বাংলা লেখা লিফলেট তৈরি করলাম। আমরা এটি মানুষের মধ্যে বিতরণ করলাম।
প্রশ্ন : অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা আছে, স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাই বোধ হয় বাংলাদেশে হচ্ছে না। এ বিষয়ে কিছু বলুন?
উত্তর : বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব। যদি কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা নেব, তাহলে যা যা চিকিৎসা পদ্ধতি দরকার এর সবই এখানে রয়েছে। আর যদি কেউ না জানেন, তাদের জানানো আমাদের কর্তব্য। এই লিফলেটের পাশাপাশি আমরা সবাইকে অনুরোধ করলাম, আপনারা এ বিষয়ে লেখেন।
এর বাইরেও সরাসরি যোগাযোগের একটি আলাদা ভূমিকা রয়েছে। তখন আমরা মহিলা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হল, কর্মজীবী মহিলা—এসব মানুষের কাছে যাওয়া শুরু করলাম। করপোরেট হাউসগুলোতে আমরা যাচ্ছি। পরে দেখলাম, শুধু ঢাকা শহরে নয়, আমাদের বিভাগীয় পর্যায়ে যাওয়া উচিত। এ পর্যন্ত আমরা ৫৮টি জেলায় অনুষ্ঠান করেছি।
স্তন ক্যানসার নিয়ে তো আমাদের ২০০৫ থেকে কার্যক্রম, প্রথম দিকে আমরা যখন মেয়েদের একটি কলেজে গেলাম, ঢাকারই একটি কলেজে, সেখানে স্তন ক্যানসার এবং জরায়ুর ক্যানসারের কথা আসছিল। হঠাৎ দেখি, সব মেয়ে মাথা নিচু করে একদম চুপ করে গেছে এবং শিক্ষকরাও বিব্রত। ‘স্তন’, ‘জরায়ু’ এই শব্দগুলোতেই তারা লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা ভাঙার জন্য তখন আমি বললাম, ধরো আমরা যে মায়ের পেটে থাকি, মায়ের পেটে তো অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে।
যেভাবে মায়ের পেটে এ রকম অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে, পাকস্থলী রয়েছে, লিভার রয়েছে, অগ্ন্যাশয় রয়েছে, ঠিক এমনি একটি অঙ্গ রয়েছে ইংরেজিতে যার নাম বলি ইউটেরাস আর বাংলায় বলি জরায়ু। আমরা জন্ম নিই মায়ের পেটের এই জরায়ুর ভেতরে। এখানেই আমরা নয় মাস সাত দিন থাকি। তিল তিল করে আমরা বড় হই।
জন্ম নেওয়ার পর আমার পুষ্টি কোথা থেকে আসে? আমার মায়ের স্তন থেকে। মায়ের বুকের দুধ হলো সৃষ্টিকর্তার অশেষ নিয়ামত, যেটা সন্তানের জন্য পুষ্টি জোগায়। এবং সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে কোলোস্ট্রাম নামক উপাদান রয়েছে, সেটাও থাকে মায়ের দুধে।
এখন বলো, একজন মা, একজন নারী যে অঙ্গে তাঁর সন্তানকে বড় করেন, যেই অঙ্গ থেকে তাঁকে পুষ্টি জোগান, সেটা কি কোনো লজ্জার বিষয় বা কোনো সংকোচের বিষয়? এটা গর্বের বিষয়, অহংকারের বিষয়। তোমরা কেন লজ্জা পাও? তখন তারা একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেল এবং আমি তখন আমার বক্তব্য খুব সুন্দর করে চালিয়ে গেলাম।
প্রশ্ন : ঢাকাতেই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা তেমন শিক্ষিত নয়, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি কী হবে?
উত্তর : হ্যাঁ। তাদের সংকোচ আরো বেশি থাকবে। এবং বিষয়টিতে এখন জোর দিতে হবে। জেলা শহর বা বিভাগীয় শহরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে সব মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া আমরা যাঁরা সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি, সেটা সরকার হোক বা আমরা যাঁরা ভলান্টিয়ার আছি, তাঁদের দায়িত্ব আছে অনেক। আমরা শুধু ঢাকা শহরে কাজ করব, বড় হোটেলে সেমিনার করব আর ভাবব, সব করে ফেললাম—এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এতে কতজনের কাছেই বা পৌঁছাতে পারবে? এ জন্য অন্য মিডিয়াগুলো যেমন ব্যবহার করব, তেমনি সরাসরি আমাদের গ্রামে যেতে হবে। আমাদের বিভাগীয় শহরে যেতে হবে, জেলা শহরে যেতে হবে, উপজেলা শহরে যেতে হবে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার পদ্ধতিতে সব পর্যায়কে এমন একটি অবস্থানে আনতে হবে, যেখানে অন্তত মানুষ গেলে জানতে পারবে। অন্য কারণে যদি যায় তা-ও যেন জানতে পারে, ম্তন ক্যানসারের এই ঝুঁকির কারণগুলো রয়েছে। এবং তাদের ভাষায় তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। আমরা কথা বলার সময় খুব জ্ঞানী ব্যক্তির মতো কঠিন কঠিন ভাষায় বললে তারা বুঝবে না, তাই তাদের ভাষায় যোগাযোগ করতে হবে। তাহলে আমি মনে করি, সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।
আর আমাদের ফোরাম থেকে যে কাজটি, আমরা বলি, আপনারা নিজের এলাকায় স্থানীয়ভাবে আয়োজনটুকু করেন। আমরা সেখানে যাব এবং ফোরাম থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করব।
আর আরেকটি জিনিস বলব, পুরুষ চিকিৎসক বা নারী চিকিৎসকের মধ্যে বাছবিচার না করতে। যেহেতু স্তন ক্যানসারের একটি পর্যায়ের চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার এবং আমাদের দেশে পুরুষ সার্জনদের সংখ্যা বেশি, তাই তাদের কাছ থেকেও চিকিৎসা নেওয়ার দরকার। শুধু নারী চিকিৎসক খুঁজতে গিয়ে আমরা তিন মাস অপেক্ষা করব বা যেই কাজ পাঁচ হাজার টাকায় করা সম্ভব সেটি এক লাখ টাকায় করব, সেটি কেন করতে যাব আমরা?
এই ঘাতকব্যাধির চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে ফলাফল তত ভালো হয়। এ জন্য আমরা সেখানে বাছবিচার করব না। নারী চিকিৎসক পাই তো পাব, নয়তো যেসব পুরুষ চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে রয়েছেন, তাঁদের কাছে যাব। চিকিৎসক তো চিকিৎসকই তাই না? সেখানে কেন আমরা সংকোচ করব?