মাথায় আঘাত পেলে প্রাথমিক চিকিৎসা কী?
বিভিন্ন কারণে মানুষ মাথায় আঘাত পায়। মাথায় আঘাত পাওয়ার বেশ উন্নত চিকিৎসাই এখন বাংলাদেশে করা হচ্ছে। আজ ২ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৯৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. সৌমিত্র সরকার।
প্রশ্ন : হেড ইনজুরি বা মাথায় আঘাত পাওয়ার পেছনে কী কী কারণ রয়েছে?
উত্তর : আসলে মাথায় আঘাত পাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। দেখা গেছে, প্রায় ৪১ ভাগ মানুষ আঘাত পায় সড়ক দুর্ঘটনায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যতগুলো সড়ক দুর্ঘটনায় রোগী মারা যাচ্ছে, এর মধ্যে ৭০ ভাগই মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া ওপর থেকে পড়ে যাওয়া, মারামারি করে মাথায় আঘাত পাওয়া অথবা কোনো ভারী জিনিস মাথার ওপর পড়ে যাচ্ছে-এসব কারণেও মাথায় আঘাত পায়।
আরো কিছু আঘাত রয়েছে, ‘অকুপেশনাল হ্যাজার্ড’ বলি যেগুলোকে। কাজ করতে গিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি পড়ে গেল। আরো কিছু আঘাত রয়েছে, যেগুলো আমাদের দেশের জন্য প্রচলিত। যেমন : অনেক সময় হয়তো মাথার মধ্যে একটা ডাব পড়ে গেল। মাথার মধ্যে তাল পড়ে গেল। এমনকি অনেক সময় কাঁঠালও পড়ে।
আরেকটি আঘাত হয়, বাচ্চারা হয়তো টিভি ট্রলি টান দিতে গিয়ে টিভিটা পড়ে যায়। আমাদের দেশের মানুষজন খুব হালকা ট্রলি ব্যবহার করে টিভি রাখার জন্য। এগুলো সাধারণত মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণ।
প্রশ্ন : মাথায় আঘাতটি খুব মারাত্মক হয়েছে কি না, সেটি বোঝার জন্য কি কোনো উপসর্গ রয়েছে?
উত্তর : আসলেই মাথায় আঘাত মারাত্মক একটি বিষয়। কারণ আমাদের দেহের যতগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে, সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, একটি পরিবারে যেমন অভিভাবক থাকে এবং তার প্রতিটি সদস্যের কার্যক্রমকে সে নিয়ন্ত্রণ করে। ঠিক একইভাবে মস্তিষ্ক তার সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে যদি সামান্য আঘাতও হয় মস্তিষ্কের সমগ্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সে জন্য মস্তিষ্কের আঘাতকে যদি মারাত্মক বলা হয় সেটা ভুল হবে না।
প্রশ্ন : মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে কী কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : মাথায় আঘাত পাওয়ার পর একজন রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। অথবা সে দ্বিধায় পড়ে যেতে পারে। সে কোনো কিছু মনে রাখতে পারছে না। আবার মাথাব্যথার অভিযোগ করে। সঙ্গে বমি হয়, চোখে ঝাপসা দেখে। আবার অনেক সময় নাক ও কান দিয়ে রক্ত আসতে পারে। অথবা পানির মতো আসতে পারে। অথবা দুই চোখের চারদিকে কালো হয়ে যেতে পারে। কানের পেছনেও অনেক সময় কালো হয়ে যায়। আবার কারো কারো মাথায় আঘাত পেলে খিঁচুনি হয়। শরীরের এক দিক অবশ হয়ে যেতে পারে। কথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অসংলগ্ন কথা বলে। এগুলো থাকলে আমরা বলি মাথায় আঘাত পেয়েছে।urgentPhoto
প্রশ্ন : সাধারণত একজন মানুষ মাথায় আঘাত পেলে তাৎক্ষণিক কী করতে হবে?
উত্তর : মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীর সঙ্গে অন্য আঘাত থাকতে পারে। যেমন- তার ঘাড়ে সারভাইক্যাল ইনজুরি থাকতে পারে। তার লাম্বোসেকরাল কোমড স্পাইনাল ইনজুরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার নড়াচড়া হতে হবে খুব সীমিত।
যদি মাথায় আঘাত পাওয়া কোনো রোগী দেখতে পাই প্রথমে দেখতে হবে, শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে কি না ঠিকমতো। যদি শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক না থাকে দেখব নাকে মুখে কোনো বাধা আছে কি না। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সেটি ছোট করতে হবে। অথবা কৃত্রিমভাবে মুখে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া যেতে পারে। যদি দেখা যায়, মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে জায়গাটি চেপে ধরে বন্ধ করতে হবে। আর তার নড়াচড়াটা এ জন্য সীমাবদ্ধ যে যদি বেশি টানাটানি করা হয় হয়তো ঘাড়ে আঘাত পেয়ে যেতে পারে। সেই অবস্থায় তাকে আস্তে আস্তে তুলে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : এই ধরনের আঘাত নিয়ে যখন কেউ আসে, আপনারা প্রাথমিকভাবে কী করেন?
উত্তর : সব জায়গায় নিউরো সেন্টার নেই। তাই বলে কি রোগী চিকিৎসা পাবে না? যেকোনো থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসাটা প্রথমে দিতে হবে। দেখতে হবে সে ঠিকমতো শ্বাস নিচ্ছে কি না, তার রক্ত পড়া বন্ধ করা হলো কি না। তারপর যেখানে বড় ধরনের কাটা থাকবে সেখানে সেলাই করা হলো কি না। তার সে অনুযায়ী রোগীকে মেডিকেল কলেজগুলোতে পাঠাতে হবে।
হাসপাতালে নিয়ে এলে যদি দেখা যায় যে রোগীর খিঁচুনি হচ্ছে, রোগী অজ্ঞান হয়ে আছে তখন আমরা শারীরিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। বিশেষ করে সিটি স্ক্যান করে দেখি তার শরীরের ভেতরে কোনো রক্তক্ষরণ আছে কি না। সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা দিই।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে মাথায় আঘাতে চিকিৎসা কী রকম হচ্ছে এবং মানসম্মত হচ্ছে কি না চিকিৎসা?
উত্তর : এটি আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে। মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীদের সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা নিউরো সার্জনদের দিতে হয়। কারণ মেডিকেল কলেজগুলোতে মাথায় আঘাত পাওয়ার রোগীই সবচেয়ে বেশি। মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীর মধ্যে কিছু হয়তো ওষুধে ভালো হয়, আর কিছু সংখ্যক রোগীকে অস্ত্রোপচার করতে হয়। এই অস্ত্রোপচারগুলো আমাদের দেশে যা হচ্ছে এবং বাইরের দেশে যা হচ্ছে তা প্রায় কাছাকাছি। কারণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরে সেটিই বের করে দিতে হবে। এটিই আমাদের চিকিৎসা।
প্রশ্ন : আমরা যে অনেক সময় টিভিতে দেখছি মাথায় একবার আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি চলে গেছে, আবার দ্বিতীয়বার আঘাত পেয়ে স্মৃতি ফিরে এসেছে। এটি আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
উত্তর : এটি আসলে খুব মজার একটি বিষয়। আসলে মাথায় আঘাত পেলে মানুষের স্মৃতিবিভ্রম হতে পারে। এগুলোকে বলে এমনিসিয়া। এগুলো মাথায় আঘাত পাওয়ার পরপর হয়। দেখা যায় রোগী সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। তবে আরেকটি আঘাত পেয়ে স্মৃতি ফিরে আসবে এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত নয়। সেক্ষেত্রে বিষয়টি নাটকীয়ই হবে।