অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিকারে হলিস্টিক পদ্ধতি
অসংক্রামক বা যে রোগগুলো জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায় না এ রকম ব্যাধি দিন দিন বেড়েই চলছে। এই ব্যাধিগুলো কীভাবে প্রতিকার করা যায় সে বিষয়ে আজ ২০ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২১১তম পর্বে কথা বলেছেন অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞ, হলিস্টিক হেলথ কেয়ারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস।
urgentPhoto
প্রশ্ন : অসংক্রামক ব্যাধি মানে কী? কোন রোগগুলোকে অসংক্রামক ব্যাধি বলা হয়?
উত্তর : সংক্রামক মানে হলো যেগুলো কোনো জীবাণুবাহিত রোগ। যেমন টাইফয়েড, যক্ষ্মা এগুলো। অসংক্রামক হলো যেগুলো জীবাণুবাহিত রোগ নয়। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, মাইগ্রেন, অ্যাজমা ইত্যাদি।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বলছে এই রোগগুলো দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ কী?
উত্তর : দেখেন আমরা দিনদিন অনেক সভ্য হচ্ছি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সংক্রামক রোগগুলো এখন অনেকটাই নির্মূল। বসন্ত নেই, টিটেনাস নেই, ধনুষ্টঙ্কার খুব কম। আগে কলেরার জন্য হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। এখন তা-ও মারা যায় না। তবে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে অসংক্রামক রোগ। এর অন্যতম কারণ হলো চাপ, মানসিক চাপ। আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা চিন্তা করেন, মানুষের মানসিক চাপ অনেক কম ছিল। এই অসংক্রামক রোগও কম ছিল। মানসিক চাপ দিন দিন বেড়ে চলছে। বিশেষ করে নগরায়ণ হওয়ার কারণে, যত আমরা সভ্যতার দিকে এগোচ্ছি, মানসিক চাপও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের যে খাদ্যাভ্যাস, আমরা এখন তেলযুক্ত, চর্বিযুক্ত, আঁশ কম এই ধরনের খাবার খেয়ে থাকি। তা ছাড়া আমরা হাঁটাচলা, ব্যায়াম একেবারে করি না। আমরা খাওয়াদাওয়া করি, তবে একে ভাঙি না। সবকিছু জমা হয়। এতে অসংক্রামক রোগ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। যত নগরায়ণ, যত সভ্যতা, তত এই অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি।
প্রশ্ন : এই রোগগুলো থেকে বাঁচার উপায় কী? কারণ একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অসংক্রামক ব্যাধি একটি বোঝা। এটা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। আপনার মত কী?
উত্তর : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, আমাদের ৮০ ভাগ রোগ হলো সাইকোসোমাটিক। এ ছাড়া কয়েক বছর আগে হার্ট কনফারেন্স হয়ে গেল, তাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ৮০ ভাগ লোকের হার্ট অ্যাটাক হলে চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই। আবার দেখেন এবার বিশ্ব হার্ট দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল সর্বত্র, সবার জন্য সুস্থ হার্ট। এখন দেখেন আমরা উন্নত হচ্ছি, তবে হৃদরোগের জন্য যেই হাসপাতালগুলো, সেগুলো শহরকেন্দ্রিক। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে দু-একটি জায়গায়। অন্য কোনো জায়গায় এর চিকিৎসা তেমনভাবে পৌঁছায়নি। কিছু জায়গায় হয়েছে। আবার সবার জন্য নয়। যাদের পয়সা আছে যেন তাদের জন্য। কারণ এটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। তাই সর্বত্র, সবার জন্য যদি সুস্থ হার্ট করতে হয় একমাত্র পদ্ধতি হলো হলিস্টিক পদ্ধতি।
প্রশ্ন : হলিস্টিক পদ্ধতি কী?
উত্তর : হলিস্টিক পদ্ধতি হলো হোল (সম্পূর্ণ) শরীরের চিকিৎসা। এই চিকিৎসা হলো শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির চিকিৎসা। ওষুধ দিয়ে কেবল শারীরিক উন্নতি করতে পারি। তবে মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে পারি না। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন আত্মা, মন ও দেহের উন্নতি। এই তিনটি জিনিসের যখন আমরা উন্নতি করতে পারি তখন আমাদের অসংক্রামক রোগগুলো প্রতিকার করা সম্ভব।
প্রশ্ন : এ রকম সমন্বিত চিকিৎসার জন্য যে হলিস্টিক পদ্ধতির কথা বলছেন, সেই বিষয়টি কীভাবে করেন?
উত্তর : যখন আমাদের কাছে রোগীরা আসে আমরা আত্মাকে উন্নত করার চেষ্টা করি মেডিটেশনের মাধ্যমে। মনকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করি কতগুলো নিউরোবিক ব্যায়ামের মাধ্যমে। আর শরীরকে করি যোগ ব্যায়াম প্রাণায়ম এগুলোর মাধ্যমে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপকে ইনকিউরেবল (নিরাময়হীন) রোগ বলা হয়। আমরা যে বাইরে থেকে শরীরকে চিনি, ভেতরে আত্মা এবং মন রয়েছে, এগুলো বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এগুলো ভেতরে থাকে। ভেতরের এই দুটো জিনিসকে যদি আমরা উন্নত করতে পারি তখন অনিরাময়যোগ্য রোগগুলো নিরাময়যোগ্যতে রূপান্তর হবে। এগুলো করে সমস্ত জীবনের জন্য সুস্থ থাকা সম্ভব।
প্রশ্ন : হলিস্টিক পদ্ধতি একটি চলমান পদ্ধতি। কোনো মানুষ যদি রোগে আক্রান্ত হয়ে যায় তখন ওষুধ না দিয়ে কি তাকে সুস্থ করা সম্ভব?
উত্তর : যখ্ন একটি রোগী আক্রান্ত হোন, মনে করেন হার্ট অ্যাটাক। রোগী এলো, দেখা গেল তার তিন, চার বা পাঁচটি ব্লকেজ রয়েছে। সে তো কতগুলো ওষুধ খাবে। সে যদি এই হলিস্টিক পদ্ধতি শুরু করে, তাহলে ধীরে ধীরে দেখা যায় তার অনেক উন্নতি হবে। এবং তার ওষুধ খাওয়ার পরিমাণও কমে যাবে। আমার যে সাত বছরে অভিজ্ঞতা এমন অনেক রোগী রয়েছে যারা ওষুধ একটিও খায় না। তবে সবাই জানে হার্টের রোগ হলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওষুধ চালাতে হয়। ধরেন, ডায়াবেটিস। এটি একবার হলে সারা জীবন তাকে ওষুধ খেতে হয়। এই কিছুদিন আগে আমার কাছে এক রোগী এসেছেন তিনি ইনসুলিন নিতেন, এক মাসের মধ্যে তিনি ইনসুলিন বন্ধ করতে পেরেছেন।
প্রশ্ন : এটি কী করে সম্ভব? আমরা তো জানি প্যানক্রিয়াস কাজ না করলে, পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি না করলে সুগারের মাত্রা কমবে না। সেটা যখন কাজ করছে না তখন বাইরে থেকে ইনসুলিন নিতে হচ্ছে। তাহলে এসব জিনিস বন্ধ করে তার কীভাবে চলবে?
উত্তর : যেমন ধরেন, আমরা যেই পদ্ধতিটা শুরু করি, আমাদের কিছু ব্যায়াম রয়েছে। মেডিটেশন, প্রাণায়াম এগুলোর সঙ্গে কিছু ভেষজ ওষুধ দিয়ে থাকি। যেমন ধরেন মেথি, লবঙ্গ এগুলো অ্যান্টি ডায়াবেটিকের কাজ করে। আরো কিছু জিনিস রয়েছে। যেগুলো একত্রে খেলে বেশ ভালো কাজ করে। কিছুদিন আগে আমি গ্রামের বাড়ি গিয়েছি, আমার একজন শিক্ষকের অ্যান্টি ডায়াবেটিক ওষুধ খাওয়ার পরেও সুগার থাকত অনেক। আমি তাকে কিছু ব্যায়াম এবং ভেষজ ওষুধ দিয়ে এলাম। দুই সপ্তাহ পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনার রক্তের শর্করা কত? জানালেন ছয় থেকে আটের মধ্যে থাকে। বললেন, তুমি কি জাদু দেখালে। আসলে এটা কোনো জাদু নয়। আপনি জানবেন, আমাদের যে পদ্ধতি যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়ম, মেডিটেশন এগুলো আজকের নয়। হাজার হাজার বছর আগের চিকিৎসা। এগুলো কালের গর্ভে চলে গিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে পুরোনো জিনিসই স্বর্ণ। এগুলো করলে দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ থাকা সম্ভব। এবং ওষুধ কম খেয়ে ভালো থাকা সম্ভব।
প্রশ্ন : সেই ক্ষেত্রে আপনারা ওষুধ ঠিক রেখে হলিস্টিক করছেন, উন্নতি হলে আস্তে আস্তে ওষুধ বন্ধ করছেন?
উত্তর : সেটাই করছি। কারণ একবারে ওষুধ বন্ধ করা ঠিক হবে না। কারণ সে তো এতে অভ্যস্ত রয়েছে।
প্রশ্ন : তবে কারো বেলায় যদি তার পেনক্রিয়াস একেবারেই কাজ করছে না, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস, তাহলে কী হবে?
উত্তর : সেই ক্ষেত্রেও কাজ হবে।
প্রশ্ন : তাতে ইনসুলিন তৈরি হবে কী করে?
উত্তর : তৈরি হবে। আমরা কার্বহাইড্রেট খাই, সেটির শরীরে ইউটিলাইজেশন ক্ষমতা বেড়ে যাবে। মানে ইনসুলিন তো কার্বোহাইড্রেটকে শোষণে সহায়তা করে, এখন কেউ যদি ঠিকমতো ব্যায়াম করে তাহলে সেটারও উন্নতি হবে।
প্রশ্ন : যে রোগীর উচ্চ রক্তচাপ আছে, তার তো ওষুধ খেতে হচ্ছে কিংবা যার হার্টের ব্লক আছে- সেই ক্ষেত্রে এগুলো কি হলিস্টিক পদ্ধতিতে ভালো হবে?
উত্তর : একজন রোগী রয়েছেন আমার, তাঁর হার্টে পাঁচটি ব্লক রয়েছে। উনি দুই মিনিটও হাঁটতে পারেন না, কষ্ট হয়। তার স্ত্রী রাতে নাকে হাত দিয়ে দেখতেন তিনি জীবিত না মৃত? তখন তিনি আমার কাছে এলেন। এগুলো করার পর তার দু-চার মাসের মধ্যে উন্নতি হয়, এক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ ফিট। উনি হজও করেছেন এর মধ্যে। আমার আরেকজন রোগী রয়েছেন তাঁরও অনেক সমস্যা ছিল। পাঁচ বছর চিকিৎসা করেছেন। উনি এখন সেজদা দিতে পারেন, এক দেড় মাইল হাঁটতে পারেন।