শীতে প্রবীণদের ত্বকের যত্ন
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলায়, বদলায় বয়সও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকে পরিবর্তন আসে। বয়সের সঙ্গে ত্বকের পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তারপরও আমরা চাই সেই পরিবর্তন ধীরে আসুক এবং কম হোক।
বয়সের সঙ্গে ত্বকে নানা পরিবর্তন আসে, যেমন ত্বকে ভাঁজ পড়া, চামড়া কুঁচকে যাওয়া এবং বলিরেখা পড়া ইত্যাদি। এগুলো সবই খুব স্বাভাবিক পরিবর্তন।
ত্বক সারাক্ষণ নানা রকম প্রতিকূল আবহাওয়া, সূর্যরশ্মি, ধুলা-ময়লা ইত্যাদির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া ধূমপান ও নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্যাদিও ত্বকে ক্ষতি করে, আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ত্বকের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ও ত্বককে বুড়িয়ে তোলে। রোদে গেলে ত্বকে ফ্রির্যাডিকেল তৈরি হয় এবং এরা ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়ার জন্য শতকরা ৬০ থেকে ৮০ ভাগ দায়ী সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি।
সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অক্সিডেশনের কারণে ত্বক বয়স্ক হয়। অক্সিডেশন এক প্রকার স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। অক্সিডেশনের ফলে ত্বকের কোলাজেন ও ইলাস্টিন ফাইবারগুলো ভেঙে যায়। আর যার জন্য ত্বক তার স্বাভাবিক টান টান ভাব হারিয়ে ফেলে। তা ছাড়া অক্সিডেশনের ফলেই ফ্রির্যাডিকেল তৈরি হয়। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ফ্রির্যাডিকেল তৈরি হয়। তা ছাড়া মানসিক চাপ, দূষণ, রাসায়নিক দ্রব্য, গাড়ির কালো ধোঁয়া, কীটনাশক, ধূমপান ইত্যাদি কারণে ফ্রির্যাডিকেলের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।
বয়স্ক ত্বকে যেসব পরিবর্তন আসে
- ত্বকের এপিডার্মিস স্তর পাতলা হয়ে যায়।
- ত্বকের রঙে পরিবর্তন আসে।
- ত্বকের কোলাজেন ও ইলাস্টিন ফাইবার দুর্বল হয়ে যায়।
- ডার্মিস স্তর কমে যায় ও পাতলা হয়।
- তেলগ্রন্থির কাজ কমে যায়।
- হেয়ার ফলিকল কার্যকর থাকে না, চুল কমে যায়।
- ত্বকের রক্ত সঞ্চালন কমে যায়।
সব কিছুর ফলেই ত্বক শুষ্ক হয়ে ওঠে এবং ত্বকে বলিরেখা পড়ে, পুরুষের ত্বকের এসব পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়। আর মহিলাদের মাসিক বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায় তখন ত্বকে বয়সের ছাপ দ্রুত পড়তে থাকে।
তবে নিয়মিত ত্বকের যত্নে সুষম খাদ্যগ্রহণ, সঠিক শরীরচর্চার মাধ্যমে বয়স্ক ত্বকও সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখা যায়। ত্বক তরতাজা, বলিরেখামুক্ত রাখতে ভিটামিন এ এবং ই-এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
প্রতিদিন ৬০ মিলিগ্রাম বা এক কাপ টমেটো বা কমলা লেবুর রস খাওয়া প্রয়োজন। এতে ভিটামিন এ-র চাহিদা মিটবে আর প্রতিদিন ৮-১০ মিরিগ্রাম ভিটামিন ই প্রয়োজন। বাদাম, অলিভ ওয়েল বা ভেজিটেবল ওয়েল থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ই পেতে পারি। তা ছাড়া রঙিন ও সবুজ শাকসবজি ও ফল নিয়মিতভাবে খাওয়া প্রয়োজন। ত্বকের বয়স প্রতিরোধ করার জন্য নানা উপাদানে সমৃদ্ধ ক্রিম, লোশন বাজারে পাওয়া যায়। বলিরেখা দূর করার নানা ক্রিমের কথা বিজ্ঞাপনে প্রচারিত হয়। নানা উপাদানের কথা শোনা যায়, আসুন জেনে নেওয়া যাক কোন উপাদান ত্বকের কী উপকার কীভাবে করে।
সানস্ক্রিন
বয়স্ক ত্বকে সানস্ক্রিন নিয়মিত ব্যবহার করা খুবই প্রয়োজন।
ভিটামিন এ থেকে প্রাপ্ত রেটিনয়েডগুলো ফটোড্যামেজড বা সূর্যরশ্মিতে ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ত্বকে উপরিভাগের বুড়িয়ে যাওয়া রোধ ছাড়াও ত্বকের গভীরে কোলাজেন ফাইবার তৈরিতেও সহায়তা করে। রেটিনয়েড ত্বক বিশেষজ্ঞের মতামত অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে যাতে সঠিক সুবিধা পাওয়া যায় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়।
আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড
বর্তমানে বয়স্ক ত্বকে আলফা হাইড্রক্সি বা এএইচএ বহুল ব্যবহৃত উপাদান। দুধ থেকে প্রাপ্ত ল্যাকটিক এসিড এবং ইক্ষু থেকে প্রাপ্ত গ্লাইকলিক এসিড খুবই কার্যকর। এ ছাড়া মেলিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, টারটারিস এসিডও এইচএ-এর মধ্যে পড়ে, তবে তেমন ব্যবহার নেই। এতে কিছুটা এএইচএ রয়েছে তবে তা যথেষ্ট পরিমাণ নেই।
আলফা হাইড্রক্সি ত্বকের মরা কোষ সরিয়ে ফেলে ও ত্বককে আর্দ্র রাখে। এটি এপিডার্মাল ও ডার্মাল দুই স্তরেই কার্যকর।
ত্বকের রং, কোমলতা ও সতেজতা বজায় রাখতে আলফা হাইড্রক্সির জুড়ি নেই। এ ছাড়া বলিরেখার গভীরতা বাড়তে দেয় না এবং সংখ্যাও বাড়তে দেয় না এএইচএ। ত্বক বিশেষজ্ঞ কিংবা চিকিৎসকের মতামত নিয়ে আলফা হাইড্রক্সি ব্যবহার করলে যথাযথ ফল পাওয়া সম্ভব।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ফ্রির্যাডিকেল ধ্বংস করে ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। নানা রকম ক্রিম ও লোশনে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। তবে সরাসরি লাগালে ত্বকের জন্য উপকারী নাকি খেলে উপকারী এ ব্যাপারে এখনো গবেষণা চলছে।
কিছু নতুন উপাদান
- স্যালিসাইলিক এসিড : এটি এক প্রকার বিটাহাইড্রক্সি এসিড, প্রায় ১৫ বছর ধরে নানা রকম ত্বকের সমস্যায় এটি ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমান সমীক্ষায় দেখা যায়, বয়স্ক ত্বকের সমস্যায়ও স্যালিসাইলিক এসিড কার্যকর।
- পলি হাইড্রক্সি এসিড (পিএইচএ) : এএইচএ-এর সঙ্গে পিএইচএর বড় রকম কোনো পার্থক্য নেই। গ্লুকোনোল্যাকটোন জাতীয় উপাদানই পলি হাইড্রক্সি অ্যাসিড।
- ফারফারাইলেডিনিন : একে কাইনেরেজও বলা হয়। এর কার্যকারিতা এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়নি।
- ইউনিকুইনোন অথবা কিউ ১০ : ত্বকে সাধারণভাবেই অল্প পরিমাণে কিউ ১০ থাকে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বলিরেখার গভীরতা ৩০ ভাগ কমায় কিউ ১০।
- এপিডার্মার গ্রোথ ফ্যাক্টর, বিটপাগ্লুকান এবং রুপার পেপটাইড কমপ্লেক্স : এগুলো সম্পর্কে এখনো গবেষণা চলছে, তবে ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে বলে ধারণা করা হয়।
লেখকা : সহযোগী অধ্যাপিকা, ফার্মাকোলজি অ্যান্ড থেরাপিউটিকস, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ।