বন্ধ্যাত্ব কেন বাড়ছে?
সন্তান একটি দম্পতির জন্য বেশ কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তবে বর্তমানে বন্ধ্যাত্বের বিষয়টি বেড়ে যাচ্ছে। বন্ধ্যাত্ব নিয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩১৩তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : বন্ধ্যাত্ব আজকাল একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। এটি ধীরে ধীরে বাড়ছে। এর পেছনের কারণগুলো কী?
উত্তর : বন্ধ্যাত্ব আসলে ছেলে মেয়ে দুজনেরই হয়। স্বামী-স্ত্রী যেকোনো একজনের কারণে কিন্তু বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। স্বামীর দিক থেকে যদি আমি চিন্তা করি, তাহলে তার শুক্রকীট বা ধাতুর মধ্যে কী অবস্থা আছে, এর পরিমাণ কী রকম আছে—সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই যে ধাতুর মধ্যে শুক্রকীটের কম অনুপস্থিতি সেটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আমাদের জীবন যাপনের ধরন এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে, কাজের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে, আমরা অনেক বেশি ইলেকট্রনিক জিনিস ব্যবহার করি। এটি শুক্রকীটের গুণাগুণ নষ্ট করে। একজন ছেলে সারাদিন বাইরে কাজ করে। এই গরম পরিবেশও কিন্তু শুক্রানুর গুণাগুণকে নষ্ট করে দেয়। মাদক, মদ্যপান, ধূমপান এসব কারণেও এর গুণগত মান কমে। মাদক আমাদের সমাজে অনেক চলে এসেছে। এরপর রয়েছে সংক্রমণ। বিশেষ করে গনকক্কাল ইনফেকশন। এটি স্পার্মেটিক কর্ডকে বন্ধ করে দিতে পারে। এতে দেখা যাবে তার সিমেনের মধ্যে কোনো শুক্রকীট নেই। অনেক সময় দেখা যায় জেনেটিক কারণে এটি হতে পারে।urgentPhoto
বয়স একটি বড় কারণ বন্ধ্যাত্বের জন্য। সেটি ছেলেদের বেলায় হোক বা মেয়েদের বেলায় হোক। বয়সের সাথে সাথে যে তার শুক্রকীটের পরিমাণ কমে যায়, শুক্রকীটের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। সেটিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আর কিছুটা রয়েছে হরমোনাল কারণ। শরীর থেকে যে হরমোন আসছে সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণ কাজ করছে না। অথবা তার টেস্টিস যথাযথ জায়গায় নাই। হয়তো সেটি পেটের ভেতর রয়ে গেছে।
আজকাল অনেক ক্যানসার হচ্ছে। ক্যানসারে ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ওষুধগুলো তার শুক্রাণুকে নষ্ট করে দেয়। সারাদিন যারা বাইরে দাঁড়িয়ে কাজ করে এদের বেলায় ভেরিকোসিল বেশি হয়। এই ভেরিকোসিলও শুক্রাণুর গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়।
প্রশ্ন : নারীদের ক্ষেত্রে কী কী কারণ রয়েছে?
উত্তর : নারীদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের জন্য বয়স একটি বড় বিষয়। আমাদের বিয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। পড়াশোনা, চাকরি সবকিছু মিলিয়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় ৩৯ বছর বয়সে গিয়েও বিয়ে হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব তাদের জন্য বড় সমস্যা।
এ ছাড়া বয়স যখন বেড়ে যায় বিভিন্ন অসুখ ওই নারী অঙ্গগুলোতে হয়। যেমন, জরায়ুর ভেতর টিউমার চলে আসতে পারে। অনেক সময় সংক্রমণের কারণে টিউব ব্লক হয়ে যায়। হয়তো সে চিন্তা করছে বাচ্চা এখন নেব না, পরে নেব। সে হয়তো এমআর করল, এ ক্ষেত্রে অনেক সময় সংক্রমণ হয়ে টিউবাল ব্লক হয়ে যেতে পারে।
এন্ডিমেট্রিওসিস বলে একটি অসুখ আছে। এটি ডিম্বাণুতে সিস্ট তৈরি করে এবং একে নষ্ট করে দেয়। প্রায়ই আমরা রোগীদের মধ্যে এই রোগ হতে দেখি।
প্রশ্ন : এই সমস্যাটি কীভাবে বোঝা যাবে?
উত্তর : যখন একটি বন্ধ্যা দম্পতি আসে আমরা চাই সবসময় স্বামী-স্ত্রী একসাথে আসুক। তাদের মধ্যে যদি একটি পরীক্ষা করি তার সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়। সেটা হচ্ছে, একটি সিমেন এনালাইসিস।
মেয়েদের মধ্যে যেটা করি, সেটি হলো, ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসোনোগ্রাফি। যেখানে আমি ইউট্রাসের কোনো সমস্যা আছে কি না দেখতে পাই। তার জরায়ুর ভেতর যেখানে শিশুটি থাকবে, সেই জায়গায় বৃদ্ধি ঠিক হচ্ছে কি না সেটি দেখি এবং ডিম্বাশয় আমরা দেখতে পাই। ওভারি মানে ডিমের থলি। এর মধ্যে ডিমের পরিমাণ দেখে আমরা বুঝতে পারি, এর আয়তন দেখে আমরা বুঝতে পারি। ওখানে সিস্ট আছে কি না, সেটিও আমরা দেখতে পারি। তবে যেটি আমরা দেখতে পাই না সেটি হলো টিউব। টিউব অনেক সময় ব্লক থাকে; সেটি কিন্তু দেখা যায় না। যদি টিউবের ভেতর পানি জমে ফুলে যায়, তখন টিউবটা দেখা যায়। অল্প ব্লক থাকলে সাধারণত বোঝা যায় না। এ সময় আমরা বয়স কম থাকলে একটি টেস্ট দেই বোঝার জন্য যে টিউবটি ঠিক রয়েছে কি না। তবে যাদের বয়স বেশি তাদের বেলায় ভালো পথ হলো ল্যাপারেস্কোপি করে টিউবটা দেখে নেওয়া যে এটি ঠিক আছে কি না। এর পরই চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া উচিত। কারণ আমি যদি না জেনে চিকিৎসা দেই সেটি ওই দম্পতির জন্য খুব ভালো কিছু হবে না।
প্রশ্ন : কী কারণে বন্ধ্যাত্ব হচ্ছে এটি বোঝার উপায় কী? আর নারী না কি পুরুষটির এই সমস্যা হচ্ছে—সেটি আপনারা কীভাবে নির্ণয় করেন?
উত্তর : পুরুষের ক্ষেত্রে ইতিহাসটা গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় হলো সিমেন অ্যানালাইসিস। এরপর যদি আমরা দেখি সিমেনের শুক্রকীট একেবারেই নেই তখন আমরা তার হরমোন পরীক্ষা করি। আর অনেক সময় শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। এতে আমরা সাধারণত ইউরোলজিস্টের সাহায্য নিয়ে থাকি।
আর নারীদের ক্ষেত্রে একটি ট্রান্সভ্যাজাইলাল আলাট্রাসোনোগ্রাফি করি। এরপর তার মাসে মাসে ওভুলেশন (ডিম নিঃসরণ) হচ্ছে কি না সেটার জন্য কিছু ইতিহাস। পাশাপাশি তার কিছু হরমোনাল পরীক্ষা করা হয়। হরমোন টেস্ট করলে আমরা বুঝতে পারব ডিম নিঃসরণ হচ্ছে কি না। ডিম আসার পথে কোনো বাধা আছে কি না এর জন্য টিউব টেস্ট করি। এটি করে আমরা বুঝতে পারি যে কোথায় সমস্যা হচ্ছে। যখন সমস্যা জানব তখন চিকিৎসা দেওয়া সহজ হবে।
প্রশ্ন : সঠিক রোগ নির্ণয়টা কোথায় পাওয়া যাবে। আদৌ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে কি না সেটি কী আসলে বুঝতে পারবেন?
উত্তর : সেটা রোগীরা তো বুঝতে পারবে না। তবে চিকিৎসকদেরও এই বিষয়ে একটু সতর্ক হওয়া দরকার। আমি যেই কারণগুলো বললাম সেগুলো বের করে যদি চিকিৎসা দেই, তাহলে এর সফলতা ভালো আসবে। ৩৫ বছরের নিচে মেয়েদের বয়স হলে আমরা বলতে পারি, সে এক বছর অপেক্ষা করতে পারে। তবে ৩৫ বছরে যদি কারো বিয়ে হয়, তার যদি ছয় মাসের মধ্যে গর্ভধারণ না হয়, তাকে সব পরীক্ষা করে কারণ নির্ণয় করে তার চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী চিকিৎসা দেবেন সেটি নির্ভর করে কিসের ওপর?
উত্তর : পুরুষের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা আসলে খুবই কম। যদি শুক্রাণুর পরিমাণ কম থাকে আমরা কিছু অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন দেই। তাদের জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তনের পরামর্শ দেই। ধূমপান করলে বলি এটি করবেন না। কম্পিউটারে কতক্ষণ কাজ করে বা বাইরে কতক্ষণ কাজ করে এর ওপর আমরা কিছু পরামর্শ দেই। তাকে বলা হয় ঢিলা পোশাকে থাকবেন। বিকেলবেলা বা রাতে একটু খোলা বাতাসে এক ঘণ্টা হলেও হাঁটবেন। গরম পানি বেশি ব্যবহার করা ভালো না। এতে শুক্রাণুর ক্ষতি হয়। এ ধরনের পরামর্শ দেই।
আর নারীর জন্য আমাকে আগে বের করতে হবে, যে তার ডিম নিঃসরণে কোনো সমস্যা আছে কি না। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ তরুণীদের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই দেখি। এখানে মেয়েদের অস্বাভাবিক ওজন হয়। অনেক সময় শরীরের লোমগুলো বেড়ে যায়। এদের ঋতুস্রাবও মাসে মাসে হয় না। এদের ক্ষেত্রে আমরা হরমোন পরীক্ষা করলে এই বিষয়ে আরো নিশ্চিত হতে পারি। এদের বেলায় ওভুলেশন ইনডিউসিং ড্রাগ দিতে হয়।
আর টিউব যদি ব্লক থাকে তখন একটি চিকিৎসা হলো টেস্ট টিউব বেবি। আর যদি ইউটেরাসে কোনো সমস্যা থাকে, টিউমার যদি থাকে সেটি কোন জায়গায় এটি দেখা হয়। আর ডিম্বাশয়ে সিস্ট থাকলে এর চিকিৎসা আগে করতে হবে। এরপর বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা দিতে হবে।