শব্দদূষণে কানের কী ধরনের সমস্যা হয়?
শব্দদূষণ বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। শব্দদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে নাক-কান-গলা।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩২৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক কান ও গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।
প্রশ্ন : শব্দদূষণ বলতে আসলে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : সাধারণভাবে বলি আমরা শব্দের মাঝেই বসবাস করি। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাত পর্যন্ত আমরা শব্দের একটি মায়াময় জগতে বাস করি। তবে এই মায়াময় জগৎই যখন আমাদের কানে বিরক্তি তৈরি করে, আমরা যেমন করে শুনতে পারি এর থেকে তীব্র শব্দ যদি তৈরি করে এবং বিরক্তিকর কিছু বিষয় যদি কানের সামনে উপস্থাপন করে, তাহলে সে শব্দকে আমরা আর সাধারণ শব্দ বলি না। বলি শব্দদূষণ। কাজেই শব্দদূষণ এবং শব্দ এর মাঝামাঝি সীমারেখাটা খুব সূক্ষ্ম। সামান্য অবহেলাতে, বেখেয়ালে সাধারণ শব্দটাই কিন্তু অন্য সব মানুষের কাছে শব্দ দূষণের পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
শব্দ কোথা থেকে তৈরি হয়? খেয়াল করে দেখেন সকালে ঘুম থকে উঠে রান্নাঘর থেকে শুরু করে দাঁত ব্রাশ করা, গৃহস্থালি যেসব কাজ করি, বিভিন্ন রকম যন্ত্রের সাহায্য নেই- সব জায়গাতেই শব্দ রয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা যেসব যানবাহন ব্যবহার করি, আধুনিক প্রযুক্তির যেসব ডিভাইস আছে, তার সব থেকেই কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন মাত্রায় শব্দ তৈরি হয়। কাজেই শব্দ তৈরির অসংখ্য উৎস রয়েছে এবং সেই জায়গাগুলো থেকে যখন শব্দ একসাথে তৈরি হতে শুরু করে তখন দূষণ হয়। দুজন মানুষ থাকলে সেখানে হয়তো তেমন শব্দ হয় না, তবে যখন চারজন মানুষ হয়, আটজন মানুষ হয়, চারটা গাড়ি, আটটা গাড়ি হয়, যখন মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে, তীব্র হর্ন যখন বাজতে শুরু করে, সেই জায়গাটাই খুব কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আমরা শব্দদূষণের শিকার হই। কাজেই এই শব্দদূষণ যেখান থেকে হচ্ছে যেভাবে হচ্ছে, এই বিষয়গুলো আমাদের ঠিক করে নিতে হবে।
কতটুকু শব্দ তৈরি হলে আমরা বলব, শব্দদূষণ হচ্ছে- এ সম্বন্ধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গাইডলাইন দেওয়া আছে। নীতিমালা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বাংলাদেশেও আমরা এটি অনুসরণ করার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : শব্দদূষণের কী কী প্রভাব পড়ছে আমাদের অঙ্গে?
উত্তর : আসলে শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেটি শব্দদূষণে আক্রান্ত হয় না। তবে সাধারণভাবে আমরা দেখি, শব্দদূষণে তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয় মানুষের কান। কানের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। এই যে ঘরে বসে আমরা কথা বলছি, এখানে ২০ ডেসিবেল বা এর কাছাকাছি শব্দের জগতে কথা বলছি। আমরা যখন এখন থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যাব, সেটি যদি ব্যস্ত জনপদ না হয়, তাহলে আমরা আশা করব সেখানে ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেলের মতো শব্দ উৎপাদন হবে। কিন্তু যখন আমরা আরেকটু বড় পরিসরে যাব, অনেক বেশি মানুষের ভিড়ে যাব, এই শব্দ ৬০ ডেসিবেলের মাত্রা ছাড়িয়ে ৮০/৯০/১১০ ডেসিবলে চলে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে যেটি হয়, উচ্চ শব্দে মানুষ যদি বেশি সময় ধরে থাকে, ধরেন ৬০ ডেসিবেলে একটি মানুষ যদি এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা বা এর বেশি সময় ধরে থাকে, সে সাময়িকভাবে বধির হয়ে যেতে পারে।
এই মানুষটাকেই যদি ১০০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে আমরা রেখে দিই, তাহলে ১৫ মিনিটের বেশি সময় থাকলে তার শ্রবণক্ষমতা একেবারে হারিয়ে যেতে পারে। কাজেই এখন যেহেতু আমরা একটি শিল্পায়নের যুগে বসবাস করছি, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আমরা ব্যবহার করছি এবং না জেনে, না বুঝে আমাদের তরুণ যুবারা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি গান শোনার জন্য ব্যবহার করছেন, এঁরা হয়তো না বুঝে অত্যন্ত উচ্চ স্বরে গান শুনছেন, এতে করে তাদের অন্তঃকর্ণে ক্ষতি হচ্ছে। যে ক্ষতিটা তারা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারছেন না, কিন্তু সেই ক্ষতিটি ধীরে ধীরে তাঁদের শোনার ক্ষমতাকে কেড়ে নিচ্ছে।
আমরা গবেষণা করে দেখেছি একজন মানুষকে যদি আট ঘণ্টা করে ক্রমাগত ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল শব্দের মাঝখানে রেখে দেওয়া যায়, ছয় মাস থেকে এক বছরের মাথায় লোকটি বধির হয়ে যাবেন। একজন কর্মক্ষম মানুষ যখন বধির হয়ে যান, তিনি তো সমাজের কাজে লাগেন না আসলে। তিনি নিজের জন্য একটি বিড়ম্বনা, পরিবার ও সমাজের জন্য বিড়ম্বনা। কাজেই আমরা যদি একটু সচেতন হই, তাহলে খুব সহজে এই বিষয়গুলো থেকে রক্ষা পেতে পারি।
প্রশ্ন : কারা এই ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর : প্রথমে বলব, আমাদের বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীরা, যুবারা। এরা আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। সংগত কারণে এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো, কানে শোনার যন্ত্রগুলো এরাই আগে ব্যবহার করে। তাই ঝুঁকির আশঙ্কা যাদের, তাদের মধ্যে এরা সর্বাগ্রে। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা যাঁরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করছেন, লাগাতার শব্দদূষণের মধ্যে থাকেন এঁরা অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি দল। শিল্প কারখানায়, যেখানে উচ্চ শব্দ তৈরি হয়, সেখানে যাঁরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, মাসের পর মাস কাজ করে যান, এঁরা কিন্তু বিপদের মুখে আছেন।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার কারওয়ান বাজারে একটি সাধারণ দিনে ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল শব্দ তৈরি হয়। এখানে যাঁরা কাজ করছেন, যাদের কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ শব্দরোধী ব্যবস্থা নেই, এঁরা সবাই কিন্তু বিপদের মুখে রয়েছেন। এর পাশাপাশি যাঁরা জাহাজে কাজ করেন, জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করেন, তাঁরা এই বিপদের আশঙ্কায় রয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী যাদের পেশাগত কারণে অস্ত্র চালাতে হয়, তারা যদি নিজেদের রক্ষা করবার জন্য বিশেষায়িত যন্ত্র কানে ব্যবহার না করেন, তাহলে সেই সমস্ত উচ্চ শব্দও তাঁদের কানে ক্ষতি করতে পারে।
প্রশ্ন : ক্ষতি হয়ে গেলে করণীয় কী?
উত্তর : আসলে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উৎকৃষ্ট। আমরা দেখেছি, শতকরা ৬০ ভাগ বধিরতা যা শব্দদূষণ থেকে তৈরি হয়, সেটি প্রতিরোধ করা যায়। আমরা যদি জনমানুষকে সচেতন করার জন্য এখন থেকেই উদ্যোগী হই, আইনের যদি যথাযথ প্রয়োগ হয় এবং সবাই মিলে যদি নিজেদের কান, অন্যদের কানকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, তাহলে একটি বড় অংশ আমরা নিজেদের চেষ্টায় সমাধান করে ফেলতে পারি। এর বাইরে যাঁরা স্মার্টফোন তৈরি করেন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি করেন, তাঁরা যদি ব্যবহার বিধিটা ভালোভাবে বলে দেন বা প্রোটেকটিভ ডিভাইস তৈরি করেন, তাহলেও কিন্তু আমরা আমাদের কানকে রক্ষা করতে পারি। আর বাড়িঘর তৈরির সময় আমরা যদি একটু শহরতলিতে চলে যাই, যেখানে গাছপালা আছে, যেখানে গাড়ির চলাচল কম থাকবে, শিল্প কারখানা থেকে যেই জায়গাটা একটু দূরে হবে, সেভাবে যদি আমরা আবাসনের পরিকল্পনা করি, স্কুলের পরিকল্পনা করি, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের পরিকল্পনা করি তাহলেও আমরা দূষণের হাত থেকে নিজেদের কানকে রক্ষা করতে পারি।