বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস
হিমোফিলিয়া থেকে হতে পারে পঙ্গুত্ব
আজ ১৭ এপ্রিল। বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। রোগটি সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আজ বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। এই ব্ছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সকলের জন্য চিকিৎসা : লড়ব সবে একসাথে’।
হিমোফিলিয়া একধরনের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ। এটি সাধারণত বংশানুক্রমে পুরুষদের হয়ে থাকে এবং মহিলাদের মাধ্যমে বংশানুক্রমে বিস্তার লাভ করে (অর্থাৎ পুরুষরা রোগী আর মহিলারা এর বাহক)।
শরীরের কোনো জায়গা কেটে গেলে ওই স্থান থেকে রক্ত পড়তে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে হিমোফিলিয়া রোগীর ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণ দীর্ঘস্থায়ী হয়। এর মূল কারণ হলো, জন্মগতভাবে এদের শরীরে রক্ত বন্ধ হওয়ার উপাদান ফ্যাক্টর আট অথবা নয়-এর অনুপস্থিতি।
হিমোফিলিয়া রোগের লক্ষণ
১. দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণই এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
২. অনেক সময় বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাড়ি কাটাস্থান থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়।
৩. শিশু যখন হামাগুড়ি দিতে শেখে, তখন অস্থিসন্ধিতে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ হয়ে হাঁটু, কনুই, পায়ের গোড়ালি ফুলে যায়।
৪. খৎনা করার পর অথবা দাঁত ফেলার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া।
৫. মাংসপেশিতে যেমন উরু, নিতম্ব, তলপেটের মাংসপেশিতে রক্তক্ষরণ ও ব্যথা হওয়া।
৬. সামান্য আঘাতে অথবা আঘাত ছাড়াও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
৭. হিমোফিলিয়া রোগীদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে বড় বড় অস্থিসন্ধিতে যেমন : হাঁটু, কনুই, পায়ের গোড়ালিতে রক্তক্ষরণ হয়। এতে জয়েন্ট ফুলে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সঠিক চিকিৎসা না করলে একই জয়েন্ট বা গাঁট বারবার আক্রান্ত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট জয়েন্টের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
রোগনির্ণয়
স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ, আঘাত বা খৎনা, দাঁত ফেলার পর সাময়িক রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে পুনরায় রক্তক্ষরণ হতে থাকলে এবং পজিটিভ ফ্যামিলি হিস্ট্রি অর্থাৎ মামাতো বা খালাতো ভাইদের এ ধরনের সমস্যা থেকে থাকলে হিমোফিলিয়া রোগ সন্দেহ করা যেতে পারে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষা
বিটি, সিটি, পিটি, এপিটিটি করতে হবে। আরো নিশ্চিত ও নির্দিষ্টভাবে কোন ফ্যাক্টরের অভাব তা জানার জন্য এপিটিটি মিক্সিং টেস্ট ও ফ্যাক্টর আট বা নয় অ্যাসেস করতে হয়।
হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা
এ রোগের স্থায়ী নিরাময়যোগ্য কোনো চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তবে তাৎক্ষণিকভাবে উপশমের ব্যবস্থা অবশ্যই আছে। হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসা মূলত প্রতিরোধমূলক। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তক্ষরণ বন্ধ করা, সম্ভাব্য জটিলতার চিকিৎসা করা ও পুনর্বাসন করাই এ রোগ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। হিমোফিলিয়া একটি আজীবনের রোগ। তবে সঠিক সময়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশুও আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মতো বেড়ে উঠবে, খেলাধুলা এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
(ক) চাহিদা অনুযায়ী বা ঘাটতি পূরণজনিত চিকিৎসাব্যবস্থা
বিশ্বের সর্বত্র এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যেহেতু হিমোফিলিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর ব্যয়বহুল এবং অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সে জন্য নিয়মিতভাবে ফ্যাক্টর ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। তার পরিবর্তে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অর্থাৎ আঘাত পেলে, অস্ত্রোপচারের সময় অথবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অস্থিসন্ধি, মাংসপেশিতে বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে সঠিক মাত্রায় ফ্যাক্টর ব্যবহার করে চিকিৎসা করা হয়। যখন ফ্যাক্টর দেওয়া সম্ভব হবে না বা পাওয়া যাবে না সেই ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে নিম্নলিখিত রক্ত বা রক্তে বিশেষ উপাদান দেওয়া যেতে পারে। এ উপাদনগুলো হলো ক্রায়োপ্রেসিপিটেট, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজম, তাজা রক্ত যা ছয় ঘণ্টার মধ্যে সংগৃহীত রক্ত। তবে অবশ্যই সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
(খ) ফিজিওথেরাপি
হিমোফিলিয়া ও ফিজিওথেরাপি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। হিমোফিলিয়া রোগীদের জয়েন্টে রক্তক্ষরণ সব থেকে বেশি হয়। জয়েন্টে রক্তক্ষরণের ফলে জয়েন্টগুলো ফুলে যায় এবং শেষ পরিণতি হয় পঙ্গুত্ব। ফিজিওথেরাপি একজন হিমোফিলিয়া রোগীকে পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করে।
হিমোফিলিয়া রোগীদের প্রতি কিছু পরামর্শ
১) যেসব খেলাধুলায় ব্যথা পাওয়ার আশঙ্কা থাকে যেমন : ক্রিকেট, হকি, ফুটবলজাতীয় খেলা পরিহার করা।
২) হালকা ব্যায়াম করা (যেমন : সাঁতার কাটা, হাঁটা ইত্যাদি)।
৩) ব্যথা নিরাময়ের জন্য অ্যাসপিরিন-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ না করা। তবে প্যারাসিটামল, আইব্রুফেন ও টোরাডল-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ নিরাপদ। তবে ওষুধ গ্রহণ করবেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে।
৪) জয়েন্টে বা মাংসপেশিতে রক্তক্ষরণ হলে ঘরে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। যেমন : আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে পাঁচ মিনিট বরফ দিয়ে চেপে ধরতে হবে । তারপর পাঁচ থেকে ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে পুনরায় পাঁচ থেকে ১০ মিনিট বরফের সেক দিতে হবে। রক্তক্ষরণ বেশি হলে ফ্যাক্টর ইনজেকশন দিতে হবে।
৫) হিমোফিলিয়া রোগীদের মাংসপেশিতে কোনো ইনজেকশন দেওয়া যাবে না।
৬) হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর সদস্য হতে হবে এবং সব সময় হিমোফিলিয়ার পরিচিতি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে যাতে করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চিকিৎসার কাজে সহায়তা হয়।
৭) একজন হিমোফিলিয়াক ঝুঁকিপূর্ণ পেশা গ্রহণ না করে নিরাপদ পেশা যেমন : কম্পিউটার অপারেটর, শিক্ষকতা ও অফিসের ডেস্ক জব করা নিরাপদ।