দুর্ঘটনায় হাড় বেরিয়ে এলে প্রাথমিক করণীয়
দুর্ঘটনায় হাড় ভেঙে চামড়া ও মাংস ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসাকে বলা হয় ওপেন ফ্রাকচার। প্রাথমিক অবস্থায় যদি এর ভালোভাবে চিকিৎসা করা হয়, তাহলে রোগী অনেক দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪০৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল কবীর। তিনি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিকস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ওপেন ফ্রাকচার বলতে আমরা কী বুঝি।
উত্তর : হাড়ের কারণে যত রোগ আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে জটিল হলো ওপেন ফ্রাকচার। ওপেন ফ্রাকচার মানে হাড় ভেঙে চামড়া ও মাংস ভেদ করে বাইরে চলে আসা। একেই বলা হয় ওপেন ফ্রাকচার। এটা খুব মারাত্মক অবস্থা। এর যদি সঠিক চিকিৎসা না হয়, বহু মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। ওপেন ফ্রাকচার অর্থোপেডিকস বিভাগের ব্যবস্থাপনার একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। একটি হাড্ডি যখনই চামড়া ভেদ করে, মাংস ভেদ করে তার আশপাশে যত ময়লা, বালুর কণা থাকে তার সংস্পর্শে আসে। জীবাণু ঢুকে যায় এবং পরবর্তী পর্যায়ের হাড্ডির সংক্রমণ, অস্টিওমায়ালাইসিস হয়ে একপর্যায়ে হয়তো হাড্ডির একটি অংশ চলে যায়, মরে যায়। তখন আর হয়তো হাঁটাচলারও কোনো সুযোগ থাকে না। এমন অবস্থাও তৈরি হয়ে যেতে পারে, যদি এই রোগের যথাযথ চিকিৎসা না হয়।
প্রশ্ন : ওপেন ফ্রাকচার কোন বয়সে হয়, কোন কারণে হয়?
উত্তর : বয়সের কোনো বিষয় এখানে নেই। তবে কারণ যেটা, আমার দেশের সবচেয়ে বড় কারণ হলো যানবাহনের দুর্ঘটনা। এটা প্রধান কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা খুব বড় দুর্ঘটনা। যখনই এটা হয়, হাড় ভেঙে মাটি ও ধুলাবালির সঙ্গে এটা একত্র হয়ে যায়। এটি হলো একটি।
দুই নম্বর হলো গাছ থেকে পড়া। ওপর থেকে পড়ে যখন ভাঙে এটা মাটির সঙ্গে, হাড়ের সঙ্গে ভেঙে মিলে যায়। তখন এটা হতে পারে। আরেকটি প্রচলিত বিষয়। খেলাধুলা করতে গিয়ে অনেক সময় এই রকম দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে হাড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন : ওপেন ফ্রাকচারে রোগী আক্রান্ত হলে তার করণীয় কী?
উত্তর : এই ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক চিকিৎসার সময় যদি ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা হয়, তাহলে পুরোপুরি যেই চিকিৎসা সেটা করার পর অনেক মানুষই ভালো হয়ে যায়। তাই যখনই ওপেন ফ্রাকচার কোথাও হয়, সেখানে প্রাথমিক অবস্থায় যে থাকবে, যে সেন্টারে যাবে, তারা কোনো অবস্থাতেই যেন ক্ষত স্থানকে সেলাই করে বন্ধ না করে দেয়। এটা আমাদের একটি প্রবণতা যে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কিছু তো একটা করতে হবে, মানুষকে দেখাতে হবে, রোগীর লোকজনকে দেখাতে হবে যে আমরা কিছু করেছি। তাই তাড়াতাড়ি তারা ওই জায়গাকে সেলাই করে বন্ধ করে দিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। এটিই হলো একবারে ক্ষতিকর জিনিস।
যেটা করতে হবে হাড্ডিটা বের হয়ে আসার পরে, শুধু পানি দিয়ে সমস্ত হাড্ডিকে পরিষ্কার করতে হবে। জায়গাটাকে পরিষ্কার করতে হবে। যদি সাধারণ স্যালাইন পাওয়া যায়, সেটি দিয়ে পরিষ্কার করে, তারপর হাড্ডিটা মাংস বা চামড়ার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই চামড়ায় সেলাই দেওয়া যাবে না।
এখন বলতে পারেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে তখন কী করব? রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য প্রেসার ব্যান্ডিজ দিতে হবে। তবে চামড়া সেলাই করে সংক্রমণকে আরো ডেকে নিয়ে আসবেন না। ক্ষতটাকে বন্ধ করা যাবে না। ক্ষতটা সব সময় খোলা থাকবে। আপনি প্রেসার ব্যান্ডিজ দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন। যেকোনো একটা কাঠ দিয়ে বা যেকোনো কিছু দিয়ে পায়ের ভাঙা হাড়ের নড়াচড়া বন্ধ করেন। তারপর সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে যথাস্থানে পাঠিয়ে দেন। এটিই হবে সবচেয়ে উত্তম কাজ।
প্রশ্ন : যথাযথ জায়গায় যাওয়ার পর চিকিৎসার পদক্ষেপগুলো কী হয়ে থাকে?
উত্তর : আমরা যখন একসময় ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের শিক্ষা দেওয়া হতো চামড়া ভেদ করে হাড় বের হলে সেখানে আর অস্ত্রোপচার করা যাবে না। ওটা ওভাবে রেখে দিতে হবে। দেড়-দুই মাস পরে ঘা শুকোলে এরপর অস্ত্রোপচারে যেতে হবে। সেই ধ্যানধারণা এখন বাতিল হয়ে গেছে। কারণ, দিনে দিনে অর্থোপেডিকস অনেক উন্নতি করেছে। বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা তৈরি হচ্ছে। এই ভাঙাকে এখন আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমরা যদি দেখি সামান্য ছিদ্র আছে, সামান্য একটু কেটে মাংস বেরিয়ে আসছে কিন্তু বালু বা মাটির কোনো সংস্পর্শ নেই, সে ক্ষেত্রে আমরা একে ভালোভাবে পরিষ্কার করে, যতখানি সম্ভব ছিঁড়ে যাওয়া মাংস কেটে, ওই অবস্থায় আমরা ফিক্সড (ঠিক) করে দিই। এতে রোগী খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। আর যদি এমন অবস্থা হয় যে খুব বড় আঘাত, যেখানে বালু মেখে আছে, মাংস অনেক ছিঁড়ে আছে, হাড় কয়েক টুকরো হয়ে আছে, সে ক্ষেত্রে আমরা শুরুর অবস্থায় অস্ত্রোপচারে যাওয়ার পরামর্শ কোনোভাবেই দিই না। এতে সংক্রমণ আরো বেড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা ভালোভাবে জায়গাটিকে পরিষ্কার করি। প্রচুর পরিমাণে পানি দিয়ে, সাধারণত স্যালাইন দিয়ে পরিষ্কার করে, অ্যান্টিবায়োটিক সলিউশন দিয়ে এরপর একে বাইরে থেকে হাড়কে ফিক্স করে দিয়ে ক্ষতকে খোলা রাখি। একে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ড্রেসিং দিয়ে আমরা এভাবে এগোতে থাকি। যখন সংক্রমণ চলে যায়, ক্ষতটা কিছুটা নিরাময় হয়ে আসে, এরপর আবার দ্বিতীয়বারের মতো চিকিৎসায় যাই। সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসাটা দুই পর্বে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে সেটা একটু সময়সাপেক্ষ চিকিৎসা।
প্রশ্ন : এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে তো কিছু সতর্কতা তাহলে অবলম্বন করতে হবে পুরো সময়জুড়ে?
উত্তর : অবশ্যই পুরো সময়জুড়ে সতর্কতা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর হাসপাতালে থাকবার সময়টা অনেকটা বেড়ে যায়। আর যদি হাসপাতালে থাকার সময়টা আমরা কমাতে চাই, অনেক সময় আমরা সেটা করি। আমরা প্রাথমিক অবস্থাটাকে করে পাঠিয়ে দিই। স্থানীয়ভাবে ড্রেসিং করতে বলি। শেষপর্যায়ের চিকিৎসা গ্রহণের সময় আবার আসতে বলি।
প্রশ্ন : চিকিৎসার সর্বশেষ পর্যায়ে কী করা হয়।
উত্তর : দুটো জিনিস করা হয়। যদি দেখা যায় যে হাড্ডিটা পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে, কোনো রকম মৃত হাড় নেই, সেই ক্ষেত্রে আমরা ওখানে ফিক্স করে দিয়ে হয়তো পেশি বা অন্য চামড়া দিয়ে সেটাকে বন্ধ করে দিই।
আবার অনেক সময় দেখা গেল প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে যাওয়ার সময় হাড্ডিটা একটু মরে গেল। রক্ত চলাচল না থাকায় দুই ইঞ্চি বা তিন ইঞ্চি মরে গেল। তখন হাড়ে ব্যবধান হয়ে গেল। এই হাড়টি হয়তো ওজন বহনের একমাত্র হাড্ডি। এটা ছাড়া মানুষ হাঁটতে পারে না। আগে এটাকে কেটে ফেলে দিত। আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এখন আমরা আর সেই অবস্থায় নেই। কারণ, বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা এই অংশকে এখানে কেটে দিয়ে রিং ফিক্সেটর দিয়ে হাড়কে লম্বা করে এখানে এগিয়ে নিয়ে আসি। এগিয়ে নিয়ে এসে একে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করি। একটা পথ আমরা বের করি।
আরেকটি পদ্ধতি আছে, পায়ে একটি চিকন হাড্ডি থাকে। ওই হাড্ডির একটি অংশ কেটে নিয়ে এসে ট্রান্সপোজিশন করে আবার কোমর থেকে হাড্ডি নিয়ে এসে একে বাঁচিয়ে রাখি। এভাবে রোগী স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে।
প্রশ্ন : সেই ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার পরবর্তী সতর্কতা কী কী অবলম্বন করতে হবে।
উত্তর : অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সতর্কতা বলতে যেটা আমরা বোঝাই, সেটি হলো তাকে অনেক দিন পর্যন্ত পায়ে ভর না দিতে বলি। যতদিন পর্যন্ত বৃদ্ধি না হবে, ওজন বহন করবে না। তারপর আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে এক্সরে করে দেখে, যখন দেখি মোটামুটি ওজন বহনের মতো অবস্থা হয়েছে, ঠিক হয়েছে এরপর আমরা তাকে হাঁটতে দিয়ে দিই। তখন সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।