চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক
চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক ভালো হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই জন্য দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৪১১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. শাগুফা আনোয়ার। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হসপিটালে প্রধান কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : চিকিৎসক ও রোগীর পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখবেন।
উত্তর : চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একজন রোগীর রোগ ভালো হবে কি না এটা নির্ভর করছে তার সঙ্গে তার চিকিৎসকের সম্পর্ক কী রকম, তার ওপর। আমি একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে যেটা দেখেছি যে চিকিৎসকের প্রতি আস্থা থাকতে হবে।
চিকিৎসকের প্রতি যদি রোগীর আস্থা না থাকে, তাহলে কিন্তু চিকিৎসকের দেওয়া যে চিকিৎসা, সেটা মন থেকে না নিলে, চিকিৎসার কারণে তার ভালো হওয়ার, আরোগ্যের পথে যাওয়ার যে গতি, আমি মনে করি সেটা ব্যাহত হয়। তাই যোগাযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : এই ক্ষেত্রে আমাদের দর্শকরা যখন রোগী হয়ে হাসপাতালে যাবে, তাদের আসলে ভূমিকাটা কেমন? চিকিৎসকের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা কী ভূমিকা রাখতে পারে।
উত্তর : যখন কোনো রোগী যায় বা তাদের আত্মীয়স্বজনরা হাসপাতালে আসে চিকিৎসকের কাছে, তখন তাদের প্রথমেই যেটা করতে হবে, আস্থা রাখতে হবে। আমি এই চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছি, উনি আমাকে যা বলবেন আমি সেটা মেনে চলব। এটা অত্যন্ত জরুরি। আমি তাকে সন্দেহের চোখে দেখব না বা আমি তার চিকিৎসাকে অবিশ্বাস করব না। আমি এটাকে দুয়ারে দুয়ারে আরেকজনের কাছে যাচাই করে দেখব না।
আরেকটি বিষয়, রোগ সম্বন্ধে সব খুলে বলতে হবে। বিশ্বাস করে তাকে খুলে বলতে হবে। কারণ, এটি হলো রোগ নির্ণয়ে খুব জরুরি একটি জিনিস। কিছু যদি ছোটখাটো জিনিস আমি বাদ দিই, আমার ব্যক্তিগত জিনিস সেটা কিন্তু রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভুলও হতে পারে। এগুলো খুব জরুরি। চিকিৎসকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে চিকিৎসা গ্রহণ করা দরকার। চিকিৎসককে অবিশ্বাস করলে চলবে না।
প্রশ্ন : চিকিৎসকদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর : আমরা যেটা দেখি যে, হয়তো যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিতে পারেন না। তবুও আমি বলব যে ব্যস্ততার পরেও তাদের দক্ষতার জায়গা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমার যেটা মনে হয় চিকিৎসা ওনারা যেটা দিচ্ছে, ওনাদের যে জ্ঞান, সেখানে আমার মনে হয় আমরা অনেক দূর এগিয়েছি এবং সামনে আরো এগিয়ে যাব। এখানে রোগীরা যেটা চায় সেটা হলো রোগীদের সঙ্গে রোগীদের ভাষায় কথা বলা। আমাদের চিকিৎসা শিক্ষাটা এমন আমরা পাঁচ-ছয় বছর এবং এর পরে পড়াশোনার মধ্যে থাকতে থাকতে আমরা আসলে সাধারণ জনগণের যে ভাষাটা সেটা ভুলে যাই। আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলি।
আমাদের চিকিৎসকদের প্রতি আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তারা অবশ্যই বলেন। বলেন না তা না। তারপরও আরো কত সাবলীল করে কত সহজ করে রোগীকে রোগীর সমস্যাটা আমি বুঝিয়ে দিতে পারি এটাই আমার মনে হয় আস্থার একটা বিরাট জায়গা। এখানে আমাদের চিকিৎসকরা আরো অনেক কাজ করতে পারেন।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সম্পর্কটা কেমন?
উত্তর : এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে আরো ভালো হওয়ার অনেক জায়গা আছে। আমি বলব না একেবারে সর্বশ্রেষ্ঠ। তবে বলব আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। তবে আরো অনেক ভালো করার সুযোগ আছে।
প্রশ্ন : সেইগুলো যদি একটু বলতেন...
উত্তর : রোগীর প্রতি ধৈর্য রাখা। রোগীর কথাগুলোকে ধৈর্য ধরে শোনা। আমাদের চিকিৎসকরা সব সময়ই শোনেন। তবে মাঝে মাঝে ব্যস্ততার জন্য পারেন না। আর রোগীকে বুঝিয়ে বলা কেন তার আসতে দেরি হলো। যেই সময় রোগীকে দেখার কথা ছিল উনি হয়তো একটা অস্ত্রোপচারে ব্যস্ত ছিলেন। যেটা হয়তো শেষ হওয়ার কথা ছিল ২টায়, হয়তো আড়াইটায় শেষ হলো। এগুলো একটু রোগীকে বুঝিয়ে বলা। অপারগতাগুলোকে বুঝিয়ে বলা। সেও যে একজন মানুষ, সে হয়তো ওই সময় একটু ক্লান্ত ছিল, সেই সময় তার হয়তো একটু মেজাজ খারাপ ছিল, এটা বোঝা। রোগীর সমস্যাটাকে বুঝে ওভাবে একটু কাছে যাওয়া।
প্রশ্ন : এমনও কথা প্রচলিত আছে যে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চিকিৎসকের আচরণ বা চিকিৎসকের ব্যবহারেই রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে বলবেন?
উত্তর : হ্যাঁ, আমরাও এগুলো শুনি। আমাদের দেশের রোগীরা যখন দেশের বাইরে যায়, ওখানে যে ডাক্তাররা আছেন, তাঁরাও যখন একজন বাংলাদেশের রোগী দেখেন, আমি নিশ্চিত যে তাঁরা তাঁদের সাধারণ রোগীকে যে সময় দেন, তার চেয়ে আমাদের রোগীদের বেশি সময় দেন। আমার মনে হয়, এরকম ঘটনা যত বেশি আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি শোনা যায়। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের ভালো ভালো কথাগুলো আমরা হয়তো শুনি না। আমাদের দেশের খারাপগুলোই আমরা বেশ জোরালোভাবে বলি। আমাদের দেশেও এরকম চিকিৎসকরা আছেন যে তার ব্যবহারে রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের দেশেও এমন অনেক চিকিৎসক রয়েছেন।
আমাদের দিনের শেষে বুঝতে হবে রোগী কী চায়। রোগী যা চায় সেটা শুধু চিকিৎসা নয়। এর পাশাপাশি রোগী ভালো ব্যবহার চায়। রোগী একটু হাসি চায়। রোগী একটু সহমর্মিতা চায়। রোগী যদি চায় চিকিৎসক হিসেবে সেটা আমার দিতে হবে।
প্রশ্ন : সর্বোপরি চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক উন্নয়নে কী করতে হবে?
উত্তর : এই ক্ষেত্রে আমাদের আস্থা বাড়াতে হবে। সম্মান বাড়াতে হবে। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার রোগীকে যথার্থ সম্মান দিতে হবে। আমার রোগীকেও চিকিৎসকের প্রতি আস্থা বাড়াতে হবে। চিকিৎসকের প্রতি সন্দিহান হলে চলবে না। আমার রোগী ভালো হলে চিকিৎসককে আমি মাথায় তুলে রাখব, খারাপ হলে আমি ভাংচুর করব, এটা চলবে না। পারস্পরিক সম্মানবোধ বাড়াতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। আমাকে মানতে হবে চিকিৎসক শুধুমাত্র আমাকে ভালো হতে সাহায্য করে। কিন্তু রোগী যদি নিয়ম না মেনে চলে, রোগী যদি নিয়ম মেনে ওষুধ না খায়, সে হয়তো ধূমপান করে সেটা পরিহার না করে, তাকে ব্যায়াম করতে হবে সেই কথাটা সে শুনলো না, খাওয়াদাওয়ার নিয়ম মানল না, তাহলে সে ভালো হবে না। কোনো লাভ নেই। এখানে উভয়কে কাজ করতে হবে। একাধারে একজন কাজ করে যাবে, অন্যজন করবে না তাহলে হবে না। উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে।