জন্মগত হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি

জন্মগত হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা এখন বেশ সহজলভ্য বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়। আজ ১১ এপ্রিল এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০০২ পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মোহাম্মদ লোকমান হোসেন।
প্রশ্ন : জন্মগত হৃদরোগ বলতে আসলে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : যদি আমরা সহজ ভাষায় বলি জন্মগত রোগ, মানে যে রোগটি মায়ের গর্ভেই তৈরি হয়। আমরা যে পৃথিবীতে জন্ম নিই, এটা ছোট্ট একটা ভ্রূণ থাকে, যা ঘুরে ঘুরে পেটের ভেতর বিভিন্ন পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়। দুই দিক থেকে এসে জোড়া লেগে হয়। কোনো কারণে কোনো ওষুধ বা ক্রোমোজোমের অসুবিধার কারণে এই জোড়াটা যদি না হয়, তখন জন্মগত রোগ তার মায়ের গর্ভের মধ্যেই শুরু হয়।
প্রশ্ন : জন্মগত হৃদরোগ কী কী ধরনের হয়? সাধারণত এর লক্ষণগুলো কীভাবে প্রকাশ পায়?
উত্তর : জন্মের পর কোনো কোনো শিশু দেখা যায় নীল রং ধারণ করছে। আবার কোনো শিশু হয়তো স্বাভাবিক বর্ণের মধ্যেই আছে। জন্মের পরপরই একজন শিশু বিশেষজ্ঞ শিশুটির সম্পূর্ণ চেকআপ করেন। চেকআপের মধ্যে অনেক কিছুই ধরা যায়, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারণার মধ্যে চিকিৎসকদের একটি বেস লাইন তৈরি করতে হয়। অর্থাৎ একটা শিশু জন্মের পর তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব অঙ্গ পরীক্ষা করা হয়। তখনই আমরা বলতে পারি, তার কী ধরনের জন্মগত সমস্যা রয়েছে।
প্রশ্ন : যখন প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা ধারণা করেন শিশুটির জন্মগত হৃদরোগ আছে, সে ক্ষেত্রে আরো কী কী পরীক্ষা করে আপনারা পুরোপুরি নিশ্চিত হন তার সমস্যা রয়েছে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুটির মা এসে তার সমস্যাগুলোর কথা বলেন। কোনো শিশুর মা হয়তো বলছেন, বাচ্চা যখন বুকের দুধ খেতে যায় তখন নীল রঙের হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো মা হয়তো এসে বলবেন, বাচ্চা খাওয়া-দাওয়া ঠিকই করছে, কিন্তু তার বৃদ্ধি হচ্ছে না। এসব সমস্যা নিয়ে আসার পর আমরা সাধারণত তাদের এক্স-রে টেস্ট, ইসিজি এবং ইকোকার্ডিওগ্রাম করতে বলি। তখন তার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে কোনো জন্মগত সমস্যা থাকলে বোঝা যায়। যেটা বাংলাদেশের সব জায়গায় করা যায়। তাই দর্শককে বলব, এই রোগ নির্ণয়ে শহরমুখী হতে হবে, তার কোনো কারণ নেই।
প্রশ্ন : সরকারি হাসপাতালগুলোতে কি এর চিকিৎসা পাওয়া যায়?
উত্তর : অবশ্যই। বাংলাদেশে এখন সমানতালে সব সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ করে হৃদরোগের চিকিৎসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই কোনো কারণে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই আমরা পেছনে পড়ে আছি।
প্রশ্ন : জন্মগত হৃদরোগে যে শিশুটি আক্রান্ত, তার বাবা-মা কোথায় গেলে এর চিকিৎসা পাবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : প্রথমে একজন কার্ডিওলজিস্টের কাছে গেলে তিনি একটা স্ক্রিনিং করবেন। তখনই তিনি একটি পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টের কাছে পাঠাবেন। কিছুদিন আগে আমরা ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের একটি ওয়ার্কশপ করলাম। বলা হলো, এর চিকিৎসায় এখন অস্ত্রোপচার করার দরকার নেই, সহজ একটি কয়েল করে দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া যায়। একটা সমস্যা হলে সেটিকে ডিভাইস ক্লোজারের মাধ্যমে বন্ধ করা যাচ্ছে। এখানে কোনো কাটাকাটির প্রয়োজন নেই। এগুলো থেকে যদি জটিল অবস্থা হয় যে সার্জারি করা লাগবে, সেটিও আমরা এ দেশে সুন্দরভাবে করে যাচ্ছি। আমি বলতে চাই, এগুলো আন্তর্জাতিক মানের সার্জারি। দেশের মাঝে বিদেশি সেবা। কেননা, সার্জারি করতে যে ম্যাটেরিয়ালগুলো ব্যবহার করি, সেগুলো বাইরে থেকে আসে। তাই কোনো অংশেই আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে আমাদের মান একটুও কম নয়। আরেকটি বিষয় বলব, যে যত কাজ করবে তার অভিজ্ঞতা তত বেশি হয়। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই বেশি সার্জারি করতে হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো।
প্রশ্ন : জন্মগত কী কী ধরনের হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে?
উত্তর : একটি হলো নীল হয়ে যাওয়া, আরেকটি নীল ছাড়া। যেগুলো নীল হয়ে যায়, এর মধ্যে প্রচলিত হচ্ছে টেট্রোলজি অব ফেলো। এ ছাড়া এএসডি এট্রিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট, ভেন্টিকুলার স্যাপটাল ডিফেক্ট, এবনোরমাল কমিউনিকেশন (পিডিএ)—এই চারটা দিয়েই জন্মগত অনেক রোগ কভার করা যায়।
প্রশ্ন : কী ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আপনারা বাংলাদেশে চালু করেছেন?
উত্তর : আমার দেশে এখন সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসাই হচ্ছে। অনেকগুলো আছে সহজ ডিভাইসের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার ছাড়াও বন্ধ করা যায়। আমরা কার্ডিওলজিস্টরা ডিভাইসের মাধ্যমে এএসডি, বিএসডিএম, পিডিএ এগুলোকে বন্ধ করে দিচ্ছি। আর যেগুলো সাইজে বড়, তাদের সার্জারি করে দিচ্ছি। এই সার্জারি করার পর শিশু বেশ ভালো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : অস্ত্রোপচারের কত দিন পর রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে বলে মনে করেন?
উত্তর : অস্ত্রোপচারের পাঁচ থেকে সাত দিন পর শিশুকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি।
প্রশ্ন : অস্ত্রোপচারের পর রোগীর ফলোআপের জন্য কত দিন পরপর যেতে বলেন? এটার প্রয়োজন আছে কি না?
উত্তর : অবশ্যই আছে। আমাদের একটি নির্ধারিত পদ্ধতি আছে। পাঁচ বা সাত দিন পর ছুটি দিলে ১০ দিন পর আবার একটা চেকআপ করি। আসার পর এক্স-রে, ইসিজি করি। এটা ঠিক থাকলে আবার এক মাস পর আসতে বলি, কোনো সমস্যা হলো কি না দেখার জন্য। সে ক্ষেত্রে ইকোস্ক্রিনিং করে ইভ্যলুয়েশন (মূল্যায়ন) করি।
প্রশ্ন : খাবার-দাবারের বিষয়ে কি কোনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে?
উত্তর : বাচ্চা সব ধরনের খাবার খেতে পারে। চিকিৎসা করার পর এটা আর রোগ থাকে না। শিশুটি স্বাভাবিক হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়।