কোমর ব্যথার কারণ ও চিকিৎসা

বর্তমান সময়ে খুব প্রচলিত একটি সমস্যা কোমর ব্যথা। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪৭১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. ইউসুফ আলী। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোপেডিকস বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
প্রশ্ন : লো ব্যাক পেইন বা কোমর ব্যথার প্রধান কারণগুলো কী কী?
উত্তর : লো ব্যাক পেইন মানে কোমরের ব্যথা। পিঠের নিচের অংশে যে ব্যথা হয়, তাকে আমরা লো ব্যাক পেইন বলে থাকি। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর ভেতরে সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হলো মেকানিক্যাল পেইন। মানে কাজ বা অভ্যাস সম্পর্কিত যেসব সমস্যাগুলো হয়। এর মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ দেখা যায় কাজ সম্পর্কিত কারণে ব্যথা হয়। যারা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে বা যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, একটি অঙ্গবিন্যাসে দীর্ঘক্ষণ থাকে, তাদের এই ব্যথাটা বেশি হয়। যেমন এখনকার দিনে দেখা যায়, যারা কম্পিউটারে কাজ করে, সর্বক্ষণ বসে কাজ করতে থাকে, তাদের দেখা যায় এই ব্যথাগুলো হয়। এই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করলে দেখা যায় সাধারণত এই ব্যথাগুলো কমে যায়।
এ ছাড়া কিছু একুয়ার্ড কারণ রয়েছে। কনজেনিটাল কারণ রয়েছে। জন্মগত কারণে কিছু হয়। যেমন জন্মগতভাবে কারো যদি মেরুদণ্ড বাঁকা হয়, এর কারণে হতে পারে। কিছু অসুখ সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে। যেমন, খুব প্রচলিত আমাদের দেশে যেটি সেটি হলো ডিস্ক প্রোলাপস। এই রোগীগুলো আমাদের দেশে খুব বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে, যেমন, আমরা যক্ষ্মা বলতে বুঝি যে, ফুসফুসে থাকবে। কাশি হবে জ্বর থাকবে-এ রকম একটি বিষয় আমাদের সামনে আসে। তবে আসলে হাড়েও যক্ষ্মা হয়, টিউবারকুলোসিস হয়। তার ভেতরে সবচেয়ে প্রচলিত হয় স্পাইনে। স্পাইন সার্জন হিসেবে দেখা যায় প্রচুর রোগী আমি পাই।
প্রশ্ন : মেরুদণ্ডে যক্ষ্মার লক্ষণ কী।
উত্তর : ফুসফুসের যক্ষ্মায় কিছু লক্ষণ হয়, সেখানে জ্বর থাকে, ওজন কমে যায়, খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি হয়। এখানে এর কিছু বিষয় থাকবে। যেমন, জ্বর থাকবে। সন্ধ্যা অথবা সন্ধ্যারাতের দিকে জ্বরটা বাড়বে। এর সঙ্গে যেটি আরো যোগ হবে সেটি হলো কোমর ব্যথা। যে জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেখানে ব্যথা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানের যেই স্নায়ু আছে, সেখানে হবে। যেমন, ঘাড়ে যদি যক্ষ্মা হয়, তাহলে তার হাতের দিকে আসবে। পিঠে যদি যক্ষ্মা হয়, তাহলে সেখানে ব্যথা হবে। তার নিচের অংশ প্যারালাইসিসের মতো হয়ে যায়। কোমরে যক্ষ্মা হলে তরুণাস্থি আরো তরল হয়ে যায়। হাড়ও নরম হয়ে যায়। পা দুর্বল হয়ে যায়। একটু অবশ অবশ লাগে। অন্য যক্ষ্মার চেয়ে এই যক্ষ্মাটি একটু জটিল।
ফুসফুসের যক্ষ্মার জন্য প্যারালাইসিস হবে না। তবে এই যক্ষ্মায় চিকিৎসা না নিলে প্যারালাইসিস হয়ে যায়। আমরা অনেক রোগী দেখতে পাই যারা দীর্ঘদিন কোমর ব্যথায় ভোগে। কিন্তু চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে প্যারালাইসিস হয়ে যায়। প্যারালাইসিস হওয়ার পর আমরা দেখি যে তার আসলে স্পাইনে যক্ষ্মা হয়েছে।
আরো কিছু কারণ রয়েছে। যদি টিউমার হয়, নরম টিস্যুর জন্য হতে পারে, যে স্নায়ুর কথা বলছি সেখানে যদি টিউমার হয়, তার জন্য হতে পারে। সরাসরি স্নায়ুতে টিউমার হলে তো সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্যারালাইসিস হয়ে যাবে।
এরপর আঘাতজনিত কারণে সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে আমরা যেসব কাজগুলোতে অভ্যস্ত নই যেসব কাজ করলে। যেমন, বাসা বদলের সময়। দেখা গেল আলমারি বদলের সময়, নিজে হয়তো একটু টান দিল, হঠাৎ তার ব্যথা শুরু হয়ে গেল। এই অনভ্যস্ততার কারণে যখনই সে টান দেয় তার চাপ বেড়ে যায়। পেছনের যে লিগামেন্ট থাকে সেটি ছিঁড়ে যায়। এই জন্য একটি বিষয়। আরেকটি বিষয় রয়েছে আমাদের পেছনে যে পেশিগুলো রয়েছে। এই পেশিগুলো অনেক সময় ভুল অঙ্গবিন্যাসের জন্য আহত হয়। বিশেষ করে যারা সব সময় মোটরসাইকেল চালায়, যারা সব সময় বসে থাকে, এদের এই সমস্যা হয়।
এমনকি আমরা যে সার্জন, আমরা যখন দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে লম্বা অস্ত্রোপচার করি, আমাদেরও ঘাড়ে ব্যথা, কোমর ব্যথা হতে পারে।
প্রশ্ন : এই বিষয়গুলো ঠিক করার জন্য পরামর্শ কী?
উত্তর : দীর্ঘক্ষণ একই অঙ্গবিন্যাসে না থেকে, আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর পাঁচ মিনিট পায়চারি করে আবার বসা। কম্পিউটারে কাজ করার সময়, কিছুক্ষণ পর পায়চারি করে আবার একটু কাজ করতে বসা। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের কোমরের পেশির কিছু ব্যায়াম আছে। এগুলো করলে অনেকটাই সুস্থ থাকা যায়। এই পেশিগুলো মজবুত থাকলে অনভ্যস্ততার কিছু কাজ করলেও সমস্যা হবে না। প্রতিরোধের জন্য প্রধান পথ হলো ব্যায়াম।
প্রশ্ন : ভারট্রিব্রাল ডিসপ্রোলাপস হলে কী ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পাবে?
উত্তর : কোমর ব্যথা হয়। সঙ্গে হলো ডিস্ক প্রলাপস হয়ে স্নায়ুর এখানে যখন চাপ দেবে, স্নায়ুর তখন প্রদাহ হয়। যখনই আমার নির্দিষ্ট পেশিটির প্রদাহ হবে, ওই স্নায়ুটি যে পেশিতে পরিবহন করবে, সেখানে ব্যথা হবে। তারপর স্নায়ুটি যখন আরো একটু ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে, তখন দেখা যাবে ব্যথাটি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। আরো যখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তখন প্যারালাইসিসের দিকে যাবে। এই সমস্যাগুলো থাকবে। এসব সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের কাছে সাধারণত রোগীরা আসে।
প্রশ্ন :এর ব্যবস্থাপনা আপনারা কীভাবে করেন?
উত্তর : এই রোগীগুলোর অধিকাংশকে আমরা বলি কনজারভেটিভ চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগী আসলে আমরা সাধারণত ওষুধ দিই। বিশ্রামে চলে যেতে বলি। ওষুধ ও বিশ্রামে অধিকাংশ ভালো হয়ে যায়। এরপরও যাদের ভালো না হয়, তাদের জন্য আমরা কিছু চিকিৎসা ব্যবহার করি। অপারেটিভ চিকিৎসা রয়েছে। এই অস্ত্রোপচারগুলো আধুনিক চিকিৎসায় অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।
বহির্বিশ্বেও শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও আমরা করছি। আমরা আগে যেমন অনেক লম্বা করে কেটে অস্ত্রোপচার করতাম, এখন আমরা এটি না কেটেও এন্ডোস্কোপির সাহায্যে আনতে পারি। আবার কিছু কিছু ডিস্ক আছে যেটা কেটেই অস্ত্রোপচার করতে হবে। আবার কিছু ডিস্ক প্রলাপস আছে, যেটা না কেটেও আমরা করে থাকি। নিউক্লিওপ্লাস্টি বলে একটি বিষয় রয়েছে, সেটি করি।
প্রশ্ন : এসব চিকিৎসার পর কি পুরোপরি সুস্থ হয়?
উত্তর : সুস্থ হয়। তবে সবার আগে চিকিৎসককে বুঝতে হবে এই রোগীর জন্য আমি কোন চিকিৎসাটা দেব।
প্রশ্ন : চিকিৎসা দেওয়ার পর রোগীদের প্রতি আপনাদের পরামর্শ কী থাকে।
উত্তর : রোগীকে আমরা বলে থাকি অস্ত্রোপচারের পরে পুনর্বাসন করতে হবে। আমরা এখন কেটে অস্ত্রোপচার করলেও খুব ছোট করি। এসব রোগীকেও আমরা অস্ত্রোপচারের পর হাঁটতে বলি, ব্যায়াম দিই। আর কিছু নিয়মকানুন করতে বলি। আপনি নিচু হয়ে কাজ করবেন না, ভারী জিনিস তুলবেন না, যেসব কারণে এসব সমস্যা হয়েছে সেগুলো করবেন না। আর ব্যায়াম সারা জীবনের জন্য করে যান।