ডেঙ্গু রোগ কীভাবে হয় এবং এর প্রতিকারে করণীয়
১৭৮০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগের বিবরণ পাওয়া যায়। এই রোগের সংক্রমণ মশার মাধ্যমে হয়, তা জানা যায় ১৯০৫ সালে। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যে এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত অবশ্য ভাইরাসটি শনাক্ত করা যায়নি। এটি এখন প্রতিষ্ঠিত যে, চারটি পৃথক ধরনের ভাইরাস (টাইপ : ১-৪) ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী।
এ কথা এখন আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। এটি সাধারণত যেসব ঋতুতে মশার প্রকোপ বেশি থাকে, অর্থাৎ গরম আবহাওয়ায় বেশি ঘটতে দেখা যায়। এর সুপ্তাবস্থা, অর্থাৎ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে শুরু করে প্রথম রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়া পর্যন্ত সময় ৩ থেকে ১৫ দিন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭ থেকে ১০ দিন।
ডেঙ্গু মহামারী আকারে ভারত, থাইল্যান্ড, জাপান, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, পশ্চিম আফ্রিকা এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ইন্দোনেশিয়া, উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবীয় ও দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশে দেখা যায়।
রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ : ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলো পাঁচটি ভাগ করা যায়—
১. প্রাথমিক উপসর্গ : রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য জ্বর শুরু হওয়ার আগের ধাপে দু-একদিন শরীরে ম্যাজম্যাজ ভাব ও মাথাব্যথা।
২. রোগের তীব্র আক্রমণ : হঠাৎ তীব্র জ্বর, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, পিঠ ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথাসহ সারা শরীরে ব্যথা, চোখ মেলতে ব্যথা বোধ, বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে।
৩. জ্বর : চতুর্থ বা পঞ্চম দিন বিরতি দিয়ে ৪১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড জ্বর হয়ে থাকে, সচরাচর এই জ্বর সাত থেকে আট দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। জ্বরের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ দিনের মধ্যে রোগীর অগ্নিমন্দা, বমি বমি ভাব বা বমি, গলায় ব্যথা, নাকের ঝিল্লির প্রদাহ ও কাশি হয়ে থাকে।
৪. চামড়ার নিচে ছোট লাল ফুসকুড়ি : রোগাক্রান্তের এক থেকে দুদিনের মধ্যে বুক, হাত ও পায়ে লাল ফুসকুড়ি দেখা যায় এবং তা প্রায় এক থেকে পাঁচ দিন স্থায়ী হয়। এই ফুসকুড়ি ওঠার আগ পর্যন্ত এটি ম্যালেরিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে আলাদা করা যায় না। এই ফুসকুড়ি দেখে ডেঙ্গুর উপস্থিতি প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায়।
রোগমুক্তির পর স্বাস্থ্যের ক্রমোন্নতি খুব ধীরে ধীরে রোগমুক্তি ঘটে থাকে।
তীব্রতার দিক থেকে ডেঙ্গুকে ডব্লিউএইচও চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করছে—
প্রথম পর্যায় : ব্যথাসহ জ্বর।
দ্বিতীয় পর্যায় : প্রথম পর্যায়ের লক্ষণসহ চামড়ার নিচে, মাড়ি ও পাকস্থলী থেকে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ।
তৃতীয় পর্যায় : দ্বিতীয় পর্যায়সহ রক্তপ্রবাহে সমস্যা বা সারকুলেটরি ফেইলিওর।
চতুর্থ পর্যায় : তৃতীয় পর্যায়সহ রোগী শকে থাকে, যখন তার রক্তচাপ ও পালস পরিমাপ করা যায় না। এটি প্রধানত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তবে অনেক সময় বড়দের মধ্যে এটি মহামারীর সময় দেখা যায়।
রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
এ রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। প্যারাসিটামল সেবনে রোগের প্রচণ্ড ব্যথার উপশম ঘটে। অ্যাসপিরিন পরিহার করা উচিত। প্রয়োজনে শরীরের তরলের ঘাটতি স্যালাইন দ্বারা পূরণ ও রক্ত সঞ্চালন করা হয়। রোগীদের মশারির নিচে পরিচর্যা করা হয়। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো নির্মূল করতে হবে। বাড়ি ও আঙিনায় এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র, যেমন—গাছের নিচে ভাঙা বোতল বা গ্লাসে আবদ্ধ পানি, স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘর ও চারপাশ, ময়লা ফেলা পাত্রে আবদ্ধ পানি এসব প্রজননক্ষেত্র নির্মূল করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের সদস্যকে দায়িত্বশীল করে তোলার ওপর জোর দেওয়া উচিত, যাতে করে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই রোগের বাহকের প্রজননক্ষেত্র নির্মূল করা সম্ভব হয়। থাইল্যান্ডে এই রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বর্তমানে শিশুদের তা দেওয়া হচ্ছে।
লেখিকা : সহকারী অধ্যাপিকা, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ।