কুমিল্লার ‘রসমালাই’
‘রসমালাই’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিশেষায়িতভাবে তৈরি হওয়া মিষ্টি রসমালাই নাম ধারণ করে আমাদের কাছে জায়গা দখল করে নিয়েছে। রসমালাই দক্ষিণ এশিয়ার (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল) জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। ছোট ছোট আকারের রসগোল্লাকে চিনির সিরায় ভিজিয়ে তার ওপর জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ ঢেলে রসমালাই বানানো হয়। কথিত আছে, রসমালাই বঙ্গ তথা পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টান্ন খাদ্য। ১৯৩০ সালে এটি রসগোল্লা থেকে রসমালাই নামে পরিচিত হয়।
বাঙালি ময়রা কৃষ্ণ চন্দ্র দাস প্রথম রসমালাই তৈরি করেন। বাংলাদেশে কুমিল্লার রসমালাই বিখ্যাত। এই মিষ্টান্নের নাম বলতেই সবার আগে আসে কুমিল্লার নাম। ১৯৩০ সালে ত্রিপুরার ঘোষ সম্প্রদায়ের হাত ধরে কুমিল্লায় রসমালাইয়ের প্রচলন শুরু হয়। সে সময় ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষির বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ‘ক্ষিরভোগ’ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষিরভোগ ‘রসমালাই’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই থেকে দিন দিন এর চাহিদা ও সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ঈদ, পূজা, বিয়ে বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার এক প্রথাগত রেওয়াজ সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও ভোজনবিলাসী মানুষের কাছে ‘রসমালাই’ এক প্রিয় নাম হয়ে ওঠে।
আশার বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বীকৃতি মিলেছে।
মাতৃভাণ্ডারের জন্ম
জানা যায়, কুমিল্লা শহরের মনোহরপুর এলাকায় ১৯৩০ সালে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে দোকানে এই ‘রসমালাই’ বিক্রি শুরু হয়। খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই এ যাত্রা শুরু করেন। শুরুতেই তাঁরা রসের ভেতর ছোট ছোট আকারের মিষ্টি ডুবিয়ে বিক্রি করতেন, যা অল্প সময়ে খুব খ্যাতি লাভ করে। তখন এর নাম ছিল ‘ক্ষিরভোগ’। পরে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর অবাঙালিরা কুমিল্লায় এসে ক্ষিরভোগকে রসমালাই বলতে শুরু করে। কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন ঘটনা বিরল। জানা যায়, বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কুমিল্লার রসমালাইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে।
মাতৃভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠাতা খনিন্দ্র ও মনিন্দ্র সেন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খড়িয়ালা গ্রামের দুই ভাই খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন। ১৯৩০ সালে তাঁরা কুমিল্লায় আসেন এবং শহরের মনোহরপুর এলাকায় ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে একটি দোকান দিয়ে ‘ক্ষিরভোগ’ বা ‘রসমালাই’ বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের চাহিদা এককথায় আকাশছোঁয়া। ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃভাণ্ডারের পরিচালনা করা শুরু করেন। তবে এ দোকানের ছাউনির টিনগুলো পুরোনো আর জরাজীর্ণ। যদিও কয়েক বছর আগে সামনের অংশ কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা এক ক্রেতা জানান, দোকানের অবয়ব দেখে মনেই হচ্ছে না যে এটি কুমিল্লার ঐতিহ্যের একটি অংশ।
মাতৃভাণ্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, মাতৃভাণ্ডার নামে এ মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তাঁদের দোকানে উত্তম দে ও ক্ষিতিশ মোদক নামে দুজন অভিজ্ঞ কারিগর এই রসমালাই তৈরি করছেন। তাঁদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন। তবে মাতৃভাণ্ডারে গড়ে প্রতিদিন কত কেজি রসমালাই বিক্রি হয়, তা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘খাঁটি রসমালাই, তাই চাহিদা আছে, বিক্রিও ভালো।’
রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ বলে জানিয়েছেন এর কারিগররা। একটি পাতিলে বা কড়াইয়ে এক মণ দুধ দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩/১৪ কেজি ক্ষির তৈরি হয়। এর দুধ থেকে পাওয়া ছানার সঙ্গে পরিমাণমতো কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট গুটি বা রসগোল্লা। এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা দিয়ে এ গুটি বানানো যায়। মাতৃভাণ্ডারের কারিগর উত্তম দে জানান, এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষির তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। এক মণ দুধে এর বেশি তৈরি করলে রসমালাইয়ের আসল স্বাদ আর থাকে না।’
কুমিল্লার রসমালাইয়ের অন্যান্য দোকান
সুস্বাদু আর ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিত ‘মাতৃভাণ্ডার’ ছাড়া কুমিল্লার প্রসিদ্ধ রসমালাই পাওয়া যাবে পোড়াবাড়ী, জলযোগসহ শহরের বেশ কয়েকটি মিষ্টি দোকানেও। কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরকে কেন্দ্র করে পাশাপাশি গড়ে উঠেছে তিনটি মিষ্টির দোকান। এর মধ্যে রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার, ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার ও শীতল ভাণ্ডার। এ ছাড়া শহরের কান্দিরপাড়ে রয়েছে ‘জলযোগ’ আর ‘পোড়াবাড়ী’ মিষ্টির দোকান।
শহরের কান্দিরপাড়ে প্রতিষ্ঠিত ‘জলযোগ’ দোকানটি একসময় মুহুরি বাবুর দোকান নামে পরিচিত ছিল। এটি প্রতিষ্ঠা করেন জয় চন্দ্র রায়। এর কর্ণধার প্রতিষ্ঠাতার ছেলে স্বপন রায় বলেন, ‘আমাদের রসমালাই মিষ্টান্ন প্রিয়রা খুবই পছন্দ করেন, বিক্রিও ভালো। জলযোগের প্রধান কারিগর প্রমোদ পাল কাজ করেন প্রায় ৫১ বছর ধরে। তাঁর সঙ্গে আরো চারজন কারিগর আছেন।’
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ১৯৯৪ সালের এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সদস্য দেশগুলো। যার মধ্য দিয়ে প্রতিটি দেশ তার ভূখণ্ডে উৎপাদিত পণ্য, বস্তু ও জ্ঞানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) আইনের মাধ্যমে নিবন্ধনের অধিকারপ্রাপ্ত হয়। তবে দীর্ঘদিন নজর না দেওয়ার পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের অধীনে ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাংলাদেশের সুপরিচিত দুটি পণ্য কুমিল্লার রসমালাই ও খাদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
ভেজালের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাদ
যে স্বাদ, গুণ আর ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের চাহিদা ও খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছে সেই রসমালাই ভেজাল আর নকলের ভিড়ে জৌলুস হারাতে বসেছে। তাই আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে যেকোনো জায়গার দোকান হলে চলবে না, আসল স্বাদ পেতে হলে আসতে হবে কুমিল্লা শহরেই। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নকল ও ভেজাল রসমালাইয়ের ভিড়ে আসল রসমালাই চেনা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
কুমিল্লা শহর ও মহাসড়ক ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল রসমালাইয়ের স্বাদ অনেকেই পান না। সত্যিকারের তৃপ্তির ঢেঁকুর তখনই দিতে পারবেন, যখন চিনে নিয়ে সঠিক জায়গা থেকে আসল রসমালাই কিনতে পারবেন। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই পেতে হলে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে। এখান থেকেই প্রায় ৯০ বছর আগে অমৃত স্বাদের এই রসমালাই যাত্রা শুরু করে।