উত্তরবঙ্গের মুখরোচক খাবার 'সিঁদল'
সিঁদল। নামটা শোনামাত্রই উত্তরবঙ্গের মানুষের চোখে যেন লোভনীয় খাবার । তবে মজার বিষয় হলো এই সিঁদল এর মতো খাবার দেশের আরও অনেক অঞ্চলে আছে। যেটা অনেকেরই জানা নেই। যেমন সিলেট বা হবিগঞ্জের হিদল এবং চট্টগ্রামও খাগড়াছড়ির নাপ্পি।
তবে সিদল বলতে আমরা বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরে ছোট মাছ রৌদ্রে শুঁকিয়ে তৈরি খাবারকেই বুঝি । আবার এখানেও জেলাভেদে রান্নাতে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায় ।
সিঁদল মূলত একটি ফার্মেন্টেড ফিশ পদ্ধতি। জানা যায়, অতীতে বর্ষাকালে বিলে ঝিলে পানিতে থৈ থৈ থাকার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ প্রচুর পরিমাণে মলা ঢেলা পুঁটি ডারকা সহ নানা মাছ ধরত। একসময় তারা এসব মাছ সংরক্ষণের উপায় বের করে ফেলেন। যার ফলশ্রুতিই হলো সিঁদল।
সিঁদল তৈরির জন্য প্রথমে ছোট ছোট মাছ আগে ধুয়ে নিয়ে রৌদ্রে একটানা তিন থেকে চারদিন কড়কড়ে করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপর মিহি করে মচমচে শুকনো মাছগুলোকে ভাঙ্গাবার জন্য ঢেকি,পাটা কিংবা হামানদিস্তা ব্যবহার করা হয়। এরপর কচুর ডাটা পানিতে ধুয়ে রৌদ্রে পানি শুকিয়ে নিয়ে একইভাবে ঢেকি,পাটা, উরুনগাইন বা হামানদিস্তায় মিহি করে পেস্ট করে নিতে হবে। এরপর মাছের গুড়ো ও কচুর ডাটার পেস্ট একসঙ্গে খুব ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর হাতের তালুতে চাপ দিয়ে সিঁদলের আকৃতি দিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। তবে প্রথম দিন সবগুলো সিঁদল রৌদ্রে ফেটে গেলে হাতের চাপ দিয়ে ঠিক করে দিয়ে আবার শুকাতে হবে। এভাবে টানা দুই সপ্তাহ রৌদ্রে শুকালে সিঁদল সংরক্ষণের জন্য উপযোগী হয়। অনেক বাড়িতে মাটির হাড়িতে ছাই এর ভিতর রেখে সিদল পুরো বছর সংরক্ষণ করেন। আর বর্তমান যুগে রেফ্রিজারেটরে প্লাস্টিক মুড়িয়ে টানা দুই থেকে তিন বছর সিঁদল সংরক্ষণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া উচিত।
এবারে যদি খাওয়ার প্রক্রিয়ায় আসি তবে বলতে হয়,অঞ্চল ভিত্তিতে এর খাবার প্রক্রিয়ার ভিন্নতা নিয়ে। যেমন, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের মানুষ সিঁদল ভর্তা করে খেতেই বেশি পছন্দ করেন। সিঁদল ভর্তা এ অঞ্চলের অন্যতম প্রিয় খাবার। তবে দিনাজপুর অঞ্চলে সিঁদল বেশি জনপ্রিয় মাছের সঙ্গে রান্না করে। এই অঞ্চলে সিদল ভর্তারও প্রচলন রয়েছে যা স্বাদের দিক থেকে রংপুর জেলার সিঁদল ভর্তার থেকে কিছুটা ভিন্ন ।
রংপুরে সিঁদল ভর্তার জন্য সিঁদল সরাসরি আগুনে পুড়িয়ে কিংবা গরম কড়াইয়ে ভেজে নিয়ে পিঁয়াজ,মরিচ,রসুন,আদা,লবণ, সরিষার তেল দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে শিলপাটায় ভাল করে বেটে নিয়ে ভর্তা বানানো হয়। ঝাল ঝাল করে তৈরি এই ভর্তা আর গরম ভাতের ছবি চোখে ভাসলেই যেন জিভে জল চলে আসে।
দিনাজপুরের মানুষ প্রথমে সিদল পানিতে ভিজিয়ে নিতে হয় । এরপর নরম হয়ে গেলে শিলপাটায় বেটে নিতে হয়। এরপর পেয়াঁজ, আদা, রসুন, গুড়া মরিচ, হলুদ,শুকনো মরিচ,গরম মশলার গুড়া ইত্যাদি দিয়ে মাছ রান্না করে নেওয়া হয় । এরপর মাছ হওয়ার আগে সিঁদলের পেস্ট দিয়ে কষানো হয়। এরপর রান্না নামানোর আগে
হালকা ধনেগুঁড়া দিয়ে নামিয়ে ফেলতে হয় । রুই মাছ, টাকি মাছ সহ বিভিন্ন রকম মাছ দিয়ে সিঁদল খাওয়া যায়। মাছের মাথা দিয়ে রান্না সিঁদলও বেশ মজাদার।