যশোরের ‘কুমড়ো বড়ি’
প্রত্যেক অঞ্চলের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য থাকে। তেমনি বাংলাদেশের যশোর জেলাও এইদিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ। এ সকল ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হলো যশোরের ‘কুমড়োর বড়ি’। জেলার প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই কুমড়োর বড়ি তৈরির চল আছে, শীত আসলেই কুমড়ো দিয়ে বড়ি দেওয়া যশোরের ঐতিহ্যের অংশ।
যশোরের শার্শা, কেশবপুর, চৌগাছা ও ঝিকরগাছাসহ সকল উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে উঠানে কিংবা টিনের চালে অথবা মাচা তৈরি করে বড়ি শুকাতে দেওয়া অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।
বলা যায়, হাড় কাপানো শীতকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে যায় চাল কুমড়া দিয়ে বড়ি বানানোর তোড়জোড়। শীত আসলেই, বিশেষ করে পৌষে শুরু হলেই বড়ি তৈরির ধুম পড়ে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িতে। বাজার থেকে কিনে আনার চেয়ে তারা বাড়িতেই বানাতে পছন্দ করেন এই বড়ি। বাড়িতে বনানো বড়ির স্বাদ বেশী ভালো হয় বলে তারা মনে করেন।
শীত আসলেই একে অপরকে বড়ি দিতে সহযোগিতা করা যেনো গ্রামের বউ-মেয়েদের রেওয়াজ। যারা বড়ি বানান, তাদের মতে, যত বেশি শীত পড়ে ততো বড়ির স্বাদ বেশী হয়, আর গরমের সময় চলে আসলে বড়ির চাহিদা কমে যেতে থাকে। চাল কুমড়ার বড়ি এতোই সুস্বাদু হয় যে, যেকোনো নিরামিষ অথবা মাছের তরকারির মধ্যেই বড়ি যোগ করলে তরকারির স্বাদ অনেকাংশে বেড়ে যায়।
গ্রামের নারীরা কোনো এক সন্ধ্যায় চাল কুমড়ার খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের নরম অংশ ফেলে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে কুমড়া মিহি করে কুড়িয়ে পরিষ্কার কাপড়ে বেঁধে সারা রাত ঝুলিয়ে রাখেন, সঙ্গে মাষকলাই ডাল যেটাকে স্থানীয়দের ভাষায় বলে ঠিকরি কলাই, খোসা ছাড়িয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন সারা রাত।
পরদিন ভোরে ডালের পানি ছেঁকে মিহি করে বেটে পেস্ট তৈরি করে রাতে ঝুলিয়ে রাখা কুমড়ার সঙ্গে প্রায় সমপরিমাণ ডাল ও পরিমাণ মতো লবণ মিশিয়ে পরে কড়া রোদে পরিষ্কার কাপড়, চাটাই বা নেটের ওপর ছোট ছোট করে বড়ার মতো করে বড়ি বসিয়ে দেন। এই বড়ি যদি ভালো করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া যায়, তবে অনেকদিন পর্যন্ত খাওয়া যায়।
চাল কুমড়ার বড়ি শুধুমাত্র একটি প্রিয় খাবার নয়, এটি জেলার একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা শীতকালীন আনন্দ এবং গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে চিরকাল ধরে রাখে। তবে কালের পরিবর্তনে এই প্রচলিত ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। তবে সবাই মিলে চাইলে এটি যুগের পর যুগ ধরে রাখা সম্ভব।