কঠোর ডায়েটের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসমূহ জেনে নিন
বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার পরেও আশানুরূপ কোনো পরিবর্তন না পাওয়ার কারণে অনেকটা হতাশ হয়েই আপনি হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কঠোর ডায়েট শুরু করবেন। এখানে যেহেতু আপনার অমূল্য সম্পদ স্বাস্থ্য জড়িত, তাই এই সম্পদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে সতর্ক হোন।
যে খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে যাচ্ছেন তার ব্যাপারে ভালোভাবে জেনে নিন। কেননা খাদ্যের ওপর ভিত্তি করেই আপনার দেহের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
কঠোর ডায়েটে আপনি আপনার আশানুরূপ পরিবর্তন পাবেন ঠিকই, কিন্তু এর কিছু কুফলও আছে, যার ফলে আপনাকে দিতে হতে পারে চরম মূল্য। চলুন, এই কঠোর ডায়েটের ব্যাপারে বিশদ জেনে নেই।
কঠোর ডায়েটের রকমফের
খুব কম কার্বের ডায়েট অথবা কিটো ডায়েট, আর খুব কম ক্যালোরির ডায়েট; খুব সীমিত সময়ের জন্য এক কড়া পরিকল্পনা নেয়া হয় বিধায় এগুলো সব-ই ক্র্যাশ ডায়েটের অন্তুর্ভূক্ত।
কম কার্বের ডায়েটগুলোতে শর্করা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হয়। কিটো ডায়েটে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২৫ শতাংশ প্রোটিন এবং ৭০ শতাংশ ফ্যাট জাতীয় খাবার রাখতে হয়। যেমন মাংস, মাছ, ডিম, বাদাম, বীজ, শাকসবজি, এবং ফল বেশি খেতে হয়। কম কার্ব খাবার মানে অধিক ফাইবারযুক্ত কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট খাবার, যেমন: লাল রুটি, ওটস, লাল চাল ইত্যাদি।
কম ক্যালোরির ডায়েটে সাধারণত খুব কম ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য অল্প সময়ের জন্য নিয়ম মতো খেতে হয়। প্রথম দিন ২০০ ক্যালোরি, দ্বিতীয় দিন ৪০০ ক্যালোরি, তৃতীয় দিন ৬০০ ক্যালোরি, চতুর্থ দিন ৮০০ ক্যালোরি তারপর একদম না খেয়ে থাকা। এভাবে রুটিন চলতে থাকে। প্রতি সপ্তাহে দেড় থেকে আড়াই কেজি করে ওজন হ্রাস পাওয়ার দরুণ এ ধরনের ডায়েট প্ল্যান বেশ লোভনীয়। কম ক্যালোরির খাদ্যের মধ্যে আছে ডিম, পাউরুটি, স্যালাদ, টক দৈ, আটা রুটি, স্যুপ, আলু, বেগুন, লো-ফ্যাট দুধ, লাল শাক, মিষ্টি কুমড়া প্রভৃতি। এছাড়া নিত্য দিনের খাবারের মধ্যে যেগুলো বেশী ক্যালোরির সেগুলো খেতে হয় একদম অল্প করে।
লো-কার্ব এবং লো-ক্যালোরির পরে রয়েছে লো-ফ্যাট ডায়েট। এই ডায়েটের খাদ্য তালিকায় মোট ক্যালোরির ৩০ শতাংশেরও কম ফ্যাট যুক্ত খাবার থাকে। ভূট্টা, খৈ ভাজা, মধু, ভাত, ওটমিল, সবজি নুডুল্স, সবজি স্যুপ, মটরশুটি, মসুর ডাল, ডিমের সাদা অংশ, টুনা মাছ ইত্যাদি লো-ফ্যাটের খাবার।
কঠোর ডায়েটে মৃত্যু ঝুঁকি
অনিয়ন্ত্রিত কঠোর ডায়েটের ফলে হৃদরোগ, ডায়বেটিক্স, এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাসে ক্ষতি, কিডনী বিকল, একসাথে একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষটি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এমনকি ওজন বৃদ্ধিতে মানসিক ভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।
যুগ যুগ ধরে মিডিয়া জগতে খুব বেশী পরিলক্ষিত হয়েছে কঠোর ডায়েটের কুফলগুলো। ১৯৩৬ সালে আমেরিকান নির্বাক চলচ্চিত্রের নায়িকা আইরিন ফেনউইক (৪৯) মারা যান অতিরিক্ত ডায়েটের জন্য। ১৯৮৩ সালে হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে মারা যান আমেরিকান গায়িকা ক্যারেন কার্পেন্টার মাত্রা ২০ বছর বয়সে। তিনি লো-কার্ব হার্ড ডায়েটের পাশাপাশি ওজন কম রাখতে অতিরিক্ত ঔষধ সেবন করতেন। উরুগুয়ের ফ্যাশন মডেল লুইসেল র্যামোস (২২) অতিরিক্ত উপোস থাকার কারণে ২০০৬ সালে মারা যান। শুধু আপেল ও টমেটো দিয়ে বছরের পর বছর ডায়েট চালাতেন ব্রাজিলিয়ান ফ্যাশন মডেল অ্যানা ক্যারোলিনা রেস্টন(২১)।
২০০৬ সালে মৃত্যুর সময় তার ওজন ছিলো মাত্র ৪০ কেজি। অতিরিক্ত ওজন হ্রাসের কারণে ঘন ঘন হাসপাতালে নিতে হোতো ইসরায়েলী ফ্যাশন মডেল হিলা ইলমালিখকে। ২০০৭ সালে মারা যাবার সময় ৩৩ বছর বয়সী এই মডেলের ওজন ছিলো মাত্র ২৭ কেজি। ২০১০ সালে মারা যাবার পূর্বে প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত ব্যাধিতে ভুগছিলেন ফরাসী মডেল ও অভিনেত্রী ইসাবেল ক্যারো (২৮)।
২০২০ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জার্মান ইন্সটাগ্রাম তারকা জোসি মারিয়া (২৪) এবং বলিউড অভিনেত্রী মিষ্টি মুখার্জি (২৭)। সম্প্রতি ৯ এপ্রিল মারা গেলেন ইংলিশ টিভি তারকা নিকি গ্রাহাম। এরা প্রত্যেকেই দৈহিক ওজনের ব্যাপারে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
দ্রুত ওজন হ্রাস ও কঠোর ডায়েটের ক্ষতিকর প্রভাব
পেশীক্ষয়
কঠোর ডায়েটে ওজন হ্রাসের সাথে শুধু আপনার চর্বিই নয়, হারাবে আপনার পেশীও। চর্বি-পেশী অনুপাত অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে বিপাক হার হ্রাসের সাথে পেশী ক্ষয় হতে শুরু করে। দুর্বল পেশীগুলো প্রতিদিনের ক্রিয়াকলাপগুলো যেমন ভারী মুদি বহন করা বা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা প্রভৃতিতে অসুবিধায় পড়ে যায়।
পানিশূন্যতা
মেদগুলোর পাশাপাশি শরীরের যে অতিরিক্ত অংশগুলো ঝরে যায় তার সিংহভাগ-ই মুলত আসে পানি থেকে; চর্বির থেকে নয়। ক্যালোরি বা কার্ব গ্রহণের সময় শরীরের যে জ্বালানি খরচ হয় তার প্রাথমিক শক্তি আসে গ্লাইকোজেন থেকে যা হলো যকৃত এবং পেশীগুলিতে জমা থাকা এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট যার প্রতি গ্রামে সংযুক্ত থাকে পানি। আপনি যত কম কার্ব বা ক্যালোরি নিচ্ছেন তার সাথে সাথে এই পানিও আপনার শরীর থেকে চলে যাচ্ছে। এর ফলেই পরবর্তীতে মাথাব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা এবং মাথা ঝিম ঝিম অনুভূতি হয়।
আভ্যন্তরীণ শারীরিক ক্রিয়াকলাপের ভারসাম্যহীনতা
যে উপাদানগুলো দ্বারা শারীরিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালিত হয়, সেগুলোতে যে কোনো ধরনের ভারসাম্যহীনতা বিপদের কারণ হয়ে দাড়ায়। যেমন- খিঁচুনি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, কোষগুলোর কার্যকলাপ এবং কোষপ্রাচীরের স্তর গঠন। প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কার্যে ব্যাঘাত ঘটতে ঘটতে এক সময় পুরো শরীরের ব্যবস্থাটি অবসন্ন হয়ে পড়ে।
চুলপড়া বৃদ্ধি
স্বল্প-ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে চুল পড়া বেড়ে যায়। কারণ পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে আপনার চুলের কোষগুলোর স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে।
পুষ্টির ঘাটতি
চরম ওজন হ্রাস আপনার শরীরকে স্বাস্থ্যকর ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করে। তদুপরি, ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়ামের মতো নির্দিষ্ট পুষ্টির ঘাটতিগুলো স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক বিকাশে ক্ষতি করতে পারে। পুষ্টির ঘাটতির সাথে জড়িত রোগের উদাহরণ হলো- রক্তাল্পতা, দুর্বলতা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
পিত্তথলিতে পাথর
এই পাথর গঠনের সময় বদহজমের পাশাপাশি পিত্তথলিতে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়। মুলত হজমের খাবারের অভাবে পিত্তথলিতে হজমের রস নিঃসৃত না হলে এগুলি তৈরি হয়। এই রসগুলি তখন পিত্তথলির ভিতরে শক্ত হয়ে পিত্তথলির মুখ আটকে দেয়। ফলে বদহজম হয় যা অধিক মাত্রায় ব্যথা এবং অস্বস্তির দিকে ঠেলে দেয়।
শারীরিক শক্তি হ্রাস
অপর্যাপ্ত ক্যালোরি অনেক বেশি ব্যয় করা আপনার শক্তির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। শারীরিকভাবে ক্লান্ত বোধ করা ছাড়াও আপনার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আপনার কর্মক্ষমতার পাশাপাশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আপনার মেজাজও প্রভাবিত হতে পারে। কঠোর ওজন হ্রাস প্রায়শই ক্রমাগত বিরক্তির উদ্রেগ করে।
হীনমন্যতা
অধিকাংশ ডায়েট-ই ব্যর্থ হয়। আর এই বারবার ব্যর্থতা দীর্ঘমেয়াদী ওজন হ্রাসের দিকে নিয়ে যায়। দীর্ঘস্থায়ী ডায়েটারদের ভেতর ধারাবাহিকভাবে অপরাধবোধ, উদ্বেগ ও হতাশা, মনোন্নিবেশের অভাব এবং অবসন্নতা কাজ করে। ফলশ্রুতিতে সাধারণভাবে জীবনযাত্রার উপর তাদের আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
কঠোর ডায়েটের ঝুঁকি এড়াতে আপনার স্বাভাবিক জীবন-ধারন বজায় রেখে পরিমিত খাদ্যের সাথে পর্যাপ্ত ব্যায়াম করাটাই উত্তম। এতে খুব দ্রুত দৈহিক পরিবর্তন ঘটবে না ঠিক, কিন্তু কোনো রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই খুব আরামপ্রদভাবেই আপনি আপনার দিনযাপন করতে পারবেন। তাছাড়া প্রতিটি সাধনার জিনিস অর্জনে সময় প্রয়োজন। তাই তরুণ বয়স থেকেই যদি আপনি সুষম খাদ্যের সাথে সঠিক শারীরিক অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে পরবর্তীতে দীর্ঘসময়ের জন্য আপনি সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে সক্ষম হবেন। এছাড়া দৈনিক একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থাকাটা আপনার প্রতিটি দিনকে অর্থবহ করে তুলবে। চূড়ান্তভাবে আপনার বার্ধক্যে রোগ-বালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।