কীভাবে বুঝবেন শিশুর চোখে সমস্যা হচ্ছে
শিশুদের চোখে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি চোখকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
শিশুর চোখের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন ডা. নাফিস আহমেদ চৌধুরী। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় সিনিয়র পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩১৬তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
urgentPhoto
প্রশ্ন : একটি শিশু জন্মগতভাবে চোখে সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। আবার জন্মের পরেও চোখে সমস্যা হতে পারে। সাধারণত কী কী সমস্যা হয়?
উত্তর : জন্মগতভাবে মায়ের গর্ভ থেকে কিছু রোগ নিয়ে বাচ্চা জন্ম নিতে পারে। যেমন : চোখের ছানি, নেত্রনালি বন্ধ হওয়া, গ্লুকোমা- এই ধরনের কিছু রোগ নিয়ে শিশু জন্ম নিতে পারে। আবার জন্মের পরও কিছু রোগ আসতে পারে। যেমন : ছানি আসতে পারে জন্মের পরে, ক্যানসার জাতীয় সমস্যা যেমন : রেটিনোব্লাসটোমা হতে পারে। অথবা কিছু রোগ রয়েছে যার কোনো কারণ থাকে না, কর্নিয়াল ডেসট্রফি রোগ হতে পারে। আবার আরেকটু বড় হয়ে গেলে, ১০-১২ বছর হয়ে গেলে রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা, যার কোনো চিকিৎসা নেই, এমন রোগও হতে পারে।
আরেকটি প্রচলিত রোগ হলো, চশমাজনিত কারণে দৃষ্টি কমে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে। দেখা যায় সাধারণত চার পাঁচ বছর বয়সে এটি প্রথম ধরা পড়ে।
প্রশ্ন : কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি শিশু কম দেখছে বা একটা চোখে বেশি দেখছে। এটিও কি কারো কারো ক্ষেত্রে হতে পারে?
উত্তর : জি, এটিও হতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুর খুব ছোট বয়সে এই সমস্যাগুলো হলে বোঝার উপায় কী?
উত্তর : বাচ্চা কখনো বলতে পারে না, ‘আমি কম দেখি’। দুটো জায়গা থেকে এলে বোঝা যায়। একটি হলো, তার বাবা-মায়েরা লক্ষ করে যে, যতই তাকে টেলিভিশনের দেখার সময় পেছনের দিকে নিয়ে আসা হয়, সে সামনে চলে যায়। অর্থাৎ খুব কাছ থেকে টেলিভিশন দেখতে চায়, এটি একটি বিষয়।
অনেক সময় স্কুল থেকে অভিযোগ আসে বাচ্চা ঠিকমতো ক্লাসনোট করে না বা বাচ্চা ঠিকমতো মনোযোগ দেয় না। বোর্ডে লিখলে সেটি তুলতে পারে না। দেখা যায়, পরবর্তী দিন ঠিকমতো বাড়ির কাজ করে নিয়ে আসে না। তখন হয়তো তারা বুঝতে পারে বাচ্চার চোখে কোনো সমস্যা আছে। তখন আমাদের মতো চোখের চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
প্রশ্ন : বাচ্চাদের চোখের সমস্যা বোঝার জন্য উন্নত দেশগুলোতে প্রি-স্কুল স্ক্রিনিং করা হয়। যেটি আমাদের দেশে নেই। আপনি যুক্তরাষ্ট্রে প্র্যাকটিস করেছেন, বাংলাদেশেও করেন। ওখানকার অবস্থা কী এবং আমাদের কী করা উচিত?
উত্তর : আমেরিকাতে পদ্ধতিটিই এই রকম, যখন বাচ্চা স্কুলে যাবে, ধরেন পাঁচ বছর বয়স, তখন বাচ্চাকে একটি স্ক্রিনিং করে যেতে হয়। একটি ফর্ম দেওয়া হয়, এটি একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবে। ওই চিকিৎসক সেটি পূরণ করে, তার চোখ ঠিক আছে কি না বা কী অবস্থা এটি দেখে জমা দেবেন। এরপর তার ভর্তি শুরু হবে। তবে আমাদের এখানে সেটি তেমনভাবে হয় না। পার্থক্য হলো, স্ক্রিনিং করার কারণে প্রথমেই পাঁচ বছর বয়সে বের হয়ে আসে বাচ্চার চোখে কোনো সমস্যা আছে কি নেই।
আর একটু আগে যেটি বললেন, এক চোখের দৃষ্টি ভালো থাকে, আর এক চোখে দৃষ্টি কম থাকে এটি কিন্তু বাচ্চার জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেহেতু একটিকে সে ব্যবহার করছে, তাই অন্যটির প্রতি তার মনোযোগ থাকে না। সে বুঝতে পারে না। এমনকি অনেক প্রাপ্তবয়স্ক লোকও সমস্যাটি বুঝতে পারে না। ওই সব ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। কারো সাত আট বছর পার হয়ে গেলে তখন কিন্তু দৃষ্টিটা ভালো করার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। তাই স্ক্রিনিংটা কিন্তু এ জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার বা লাখ লাখ বাচ্চার মধ্যে হয়তো একটি বাচ্চা বের হবে চোখে সমস্যা নিয়ে। আর সেটাই কিন্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি গুরুত্বপূর্ণ তার জীবনের জন্য, চাকরির জন্য, সব কিছুর জন্য।
প্রশ্ন : প্রাথমিক অবস্থায় স্ক্রিনিং করে যদি তার সমস্যা নির্ণয় করা যায়, এতে আমরা কী সুবিধা পাচ্ছি?
উত্তর : এই বয়সে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা চশমার সমস্যাটা পাই। চশমাটা দিয়ে দিলে তার সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে আসে। আর স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার যেই আশঙ্কা থাকে, সেটি থেকে রক্ষা পায়। এতে শিশু চোখজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। এর সঙ্গে আমি একটু যোগ করতে চাই, আরো খারাপ রোগ রয়েছে যেটা সেটি হলো, রেটিনোব্লাসটোমা। সেটি কিন্তু তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সে বেশি আসে। এটি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগ। তাই স্ক্রিনিং করলে কিন্তু আমরা ওই ধরনের রোগ বের করে নিয়ে আসতে পারি এবং এর চিকিৎসা করা সম্ভব।
প্রশ্ন : শিশুরা চোখে কম দেখলে আপনারা সাধারণত চশমা দিয়ে থাকেন। তবে অনেক শিশুই চোখের সামনে এই আবরণ পড়তে পছন্দ করে না। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উপায় কী?
উত্তর : আসলে কখনো কখনো এই সমস্যা আমরা মোকাবিলা করি। এখন বিষয়টি হলো দুই ধরনের। যদি চশমার পাওয়ার বেশি থাকে, অর্থাৎ বাচ্চা অনেক কম দেখে তখন কিন্তু তাকে ঘুম থেকে ওঠার পর বলতে হয় না তুমি চশমা পরো। যেহেতু সে কম দেখতে পায়, তাই সে নিজে নিজেই চশমা খুঁজে নেয়। আর যারা এক চোখে কম দেখে আবার এক চোখে বেশি দেখে তারা কিন্তু ওই চশমা আর পরতে চায় না। আবার অনেক বাচ্চা আসে মাথাব্যথা নিয়ে। মাথাব্যথার পাওয়ার কিন্তু অনেক কম। চশমা দিলাম, দেখা গেল পরল না। অথবা স্কুলে ফেলে গেল। এসব জায়গায় বাচ্চাদের একটি ভূমিকা রাখতে হবে। স্কুলশিক্ষকদের ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রশ্ন : লেজি আইয়ের জন্য চশমার কোনো বিকল্প আছে কি?
উত্তর : চশমা তো দিতেই হবে, তার সঙ্গে আমরা ‘প্যাচ’ দিই। তবে এটি নির্ভর করে এক চোখের দৃষ্টিটা কতটুকু বসে গেছে তার ওপরে। যদি দেখি খুব বেশি বসে গেছে, তখন আমরা অগ্রবর্তী চিকিৎসায় যাই। তবে বাংলাদেশ যেহেতু উন্নত দেশ নয়, তাই আমরা সব সুবিধা পাই না। আমরা চেষ্টা করি প্রথমে ফ্রসটেট গ্লাস দিয়ে। ফ্রসটেট গ্লাস মানে বাথরুমে যেই গ্লাসগুলো থাকে, একটি চোখ যেটি ভালো সেই চোখে গ্লাসটি দিয়ে খারাপটিকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করি। আমরা বলি, যখন পড়া লেখা থাকবে না তখন টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে দেবেন। তবে বাচ্চারা সেটাকে গ্রহণ করতে চায় না। তখন আমরা এর বিকল্প হিসেবে ‘প্যাচ’-এ চলে যাই। চোখটা পুরোপুরি ঘিরে দিয়ে ‘প্যাচ’ দিয়ে দিই। এটাও যদি না পাওয়া যায়, একটি টিস্যু দিয়ে বা একটি কসটেপ দিয়ে লাগিয়ে দিতে বলি। চশমা দিলে দেখা যায় কী, বাচ্চারা চশমার ওপর দিয়ে দেখে। আর বাইরের দেশে আরো অগ্রবর্তী জিনিস বের হয়ে গেছে। একটি ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিক শিট থাকে, যেটি চশমার ওপর লাগানো থাকে। এটি বোঝাই যায় না। ভালো চোখে যে রকম পাওয়ার আছে তার সঙ্গে সমন্বয় করে এটা তৈরি করা হয়। বাচ্চা তখন কোনো সমস্যা অনুভব করে না। আমরা যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ, আমরা সব সুবিধা সব সময় পাই না। এতে যেমন বাবা-মাকে কষ্ট করতে হয়, তেমনি আমাদেরও কষ্ট করতে হয়।
শিশুকেও অনেক সময় ভয়ও দেখানো হয়। বলা হয়, ‘তুমি যদি এটা না পরো, তাহলে পরে তোমাকে ইনজেকশন দেওয়া হবে।’ অথবা ‘তোমার চোখ কিন্তু নষ্ট হয়ে যাবে।’ এভাবে বোঝাতে হয়।
প্রশ্ন : চশমা পরার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে ধারণা কাজ করে, একবার চশমা নিলে আর ছাড়া যাবে না। বিষয়টি কি ঠিক?
উত্তর : এটি অনেকটা ঠিক। যদি খুব কম পাওয়ার থাকে তবে দেখা যায় যে, একসময় হয়তো সমস্যাটা থাকে না। তবে দেখা যায় যে, যদি মাঝামাঝি পাওয়ার নিয়ে শুরু হয়, আর এটি যদি মাইনাস পাওয়ার নিয়ে হয়, তাহলে চশমা পরতে হয়। মাইনাস পাওয়ার বাড়তে থাকে ১৮ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত। তাই বিষয়টি এমন নয় যে একটি চশমা নিল, আর এটিই নির্দিষ্ট হয়ে গেল, বাচ্চা যেহেতু বাড়ন্ত, তাই বড় হতে হতে তার চোখও পরিবর্তিত হবে। এতে ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চার চোখের পাওয়ার বদলাতে থাকবে। আর যদি প্লাস পাওয়ার থাকে তাহলে খুব কম ক্ষেত্রে দেখা যায় এটি কিছুটা কমে আসে। তবে চশমা একবার লাগার পর আর লাগবে না এটি খুব কম ক্ষেত্রেই হতে পারে।
প্রশ্ন : কারো কারো বেলায় বলছিলেন মাথাব্যথা হতে পারে। মাথাব্যথার অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো চোখে ব্যথা। চোখের সমস্যার কারণে মাথাব্যথা হলে আপনারা চশমা দিয়ে থাকেন। কিছুদিন পর যদি দেখা যায় মাথাব্যথা ভালো হয়ে গেছে তখন কি চশমা না পরলে চলবে?
উত্তর : অনেক রোগী পাওয়া যায়, কিছুদিন চশমা পরার পর আর মাথাব্যথা অনুভব করে না। তখন আর চশমা পরে না। আসলে ওই চশমা কিন্তু আমরা তার দৃষ্টির জন্য দিই না। এই কারণে চশমা না পরলে তার কোনো ক্ষতি হবে না। এতে তার পাওয়ার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন তিনি চশমা পরবেন কি না। নিজে নিজে বন্ধ করা ঠিক হবে না।