ব্রিকস কি পারবে ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য ম্লান করতে?
গত ৮০ বছর ধরে বিশ্বের অন্যসব মুদ্রার ভীড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে আছে মার্কিন ডলার। তবে, আর্থিক ও বৈশ্বিক শাসনকাজে পশ্চিমাদের আবছায়া উপস্থিতির কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি পক্ষ এখন ডলারের এই আধিপত্যকে ম্লান করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এদিকে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে ব্রাজিল, ভারত, চীন ও স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা গত তিন দিন ধরে অবস্থান করছেন জোহানেসবার্গে। সেখানে মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল বক্তব্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে খর্ব করার প্রত্যয় বা ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়াকে ‘অপরিবর্তনীয়’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এর গতি ক্রমশ বাড়ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ডলার বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ৮০ শতাংশেরও বেশি বাণিজ্য হয় ডলার বিনিময়ের মাধ্যমে।
এ বছরের শুরুর দিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা প্রশ্ন তোলেন, কেন সব দেশকেই ডলারের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে হবে?এর আগে একজন রুশ শীর্ষ কর্মকর্তা জানান যে, ব্রিকস জোট তাদের নিজস্ব মুদ্রা চালু করতে কাজ করছে।
তবে, ডলারের আধিপত্য খর্ব করার প্রয়াসের ডাক নতুন কোনো বিষয় নয়, এমনকি এটা ব্রিকসের অনন্য কোনো উদ্যোগও নয়, বিষয়টি নিয়ে আগেও কথা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ব্রিকস জোটকে সামনের কাতারে নিয়ে এসেছে এই প্রয়াসকে বাস্তবে রূপ দিতে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় অর্ধেক ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যাংকগুলো সুইফট নামে যে ম্যাসেজ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেখান থেকেও রাশিয়ার প্রথম সারির ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া হয়।
ওই বছরের শেষ ভাগে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সেমিকন্ডাকটর প্রযুক্তির বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এ বিষয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের ভিজিটিং ফেলো শার্লি জে ইউ গণমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ডলারকে রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, সে কারণে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রিজার্ভের জন্য বিকল্প মুদ্রার সন্ধানে নামে। পাশাপাশি দেশগুলো সুইফটের বাইরে একটি বিকল্প বহুপাক্ষিক ক্লিয়ারিং ব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টা নেয়।’
এ প্রসঙ্গে রাশিয়া-আফ্রিকা বিষয়ক নীতি বিশ্লেষক গুস্তাভো ডি কারভালহো আলজাজিরাকে বলেন, ‘একটি বিকল্প মুদ্রা খুঁজে বের করতে বিশ্বের দক্ষিণ প্রান্তের দেশগুলোর এই উদ্যোগ যতটা না আদর্শিক তার চাইতে এটা অনেক বেশি ব্যবহারিক।’
গত সপ্তাহে জোহানেসবার্গে ব্রিকস ও বিশ্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে এক কর্মশালায় ডি কারভালহো বলেন, ব্রিকস জোট কিছু ‘আলগা’ বিকল্পের মাঝ থেকে মুদ্রা বেছে নিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর মুদ্রা, নতুন বিনিময় মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণের ব্যবহার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি।
একক ব্রিকস মুদ্রা?
সম্ভাব্য বিকল্প মুদ্রা বিবেচনার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব স্কলারশিপের অধ্যাপক ড্যানি ব্রাডলো বলেছেন, মানুষ আবারও বিনিময় মুদ্রা হিসেবে সোনায় ফিরে যাবে কি না, এ নিয়ে তিনি সন্দেহে আছেন। এক্ষেত্রে তিনি ক্রিপ্টোকারেন্সির সম্ভাব্যতার বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন, কেননা সেটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ।
ব্রাডলো এ বিষয়ে আলজাজিরাকে বলেন, ‘আপনি কোন স্থিতিশীল মুদ্রাটি ব্যবহার করবেন বা কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করবেন? এগুলোর কোনোটাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়োজনীয় নয়।’
অন্যদিকে, আলাদা ব্রিকস মুদ্রা চালুর বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা কিছুটা সংশয়ে রয়েছেন।
এ বিষয়ে শার্লি জে ইউ বলেন, ‘ব্রিকস মুদ্রা চালুর ব্যাপারে প্রয়োজন আলাদা করে কিছু প্রতিষ্ঠানের। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কিছু সৃষ্টির জন্য দরকার এক গুচ্ছ মানদণ্ড ও মূল্যবোধের। যদিও এগুলো অর্জন করা কঠিন তবে অসম্ভব নয়।’
রাশিয়া ও ইউরেশিয়া নিয়ে কৌশলগত কনসালটেন্সি সংস্থা ম্যাক্রো-অ্যাডভাইজরির বিনিয়োগ বিশ্লেষক ক্রিস ওয়েফার মনে করেন ব্রিকস মুদ্রার ধারণা আলোর মুখ দেখবে না। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত লোকজনও জানেন এটা হতে যাচ্ছে না। আগামী বেশ কিছু বছরের মধ্যে অন্তত তা হচ্ছে না।’
আর ওয়েফারের সঙ্গে একমত পোষণ করেন ব্রাডলো। তিনি বলেন, ‘ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্রিকস মুদ্রার সৃষ্টি একধরনের কল্পনা বা অবাস্তব। এক্ষেত্রে তিনি ব্রিকসের পাঁচটি দেশের আলাদা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা তুলে ধরেন।
এ প্রসঙ্গে ব্রাডলো আরও বলেন, ‘যদি দেশগুলো একতাবদ্ধ হয়ে একটি একক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে চায় সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী অর্থনীতির প্রভাবকেই মেনে নিতে হবে, তা হলো চীন। তবে, ছোট দেশগুলো তাদের মুদ্রা নীতিমালার ক্ষেত্রে এবং তাদের আর্থিক নীতির প্রশ্নে কেন চীনের অর্থনীতিকে সংযুক্ত করতে চাইবে?’
স্থানীয় মুদ্রা?
যদি ডলারের বিকল্প মুদ্রা খুঁজতে হয় তবে ব্রিকস সদস্য দেশগুলো স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহারের দিকেই হাঁটবে বলে মনে করেন ক্রিস ওয়েফার। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি রাশিয়া ও চীন তাদের ৮০ শতাংশেরও বেশি বাণিজ্যে হয় রুবল (রুশ মুদ্রা) নয়তো ইউয়ান (চীনের মুদ্রা) ব্যবহার করছে। তা ছাড়া রাশিয়া ভারতের সঙ্গে রুপিতে ব্যবসা করছে।’
এছাড়া ব্রিকসের মূল সদস্য দেশগুলোর বাইরে অন্যান্য দেশও স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন করছে। গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ডলারের পরিবর্তে রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন করার লক্ষ্য নিয়ে।
তবে, স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক ব্যবহারের কারণে নতুন একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, আর সেটি হলো মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে রূপান্তরের বিষয়টি।
এ প্রসঙ্গে ওয়েফার বলেন, ‘দেশগুলোর বাণিজ্য বাড়াতে হলে এক-অন্যের দেশে মুদ্রার রিজার্ভও বাড়াতে হবে। আর এক্ষেত্রে অন্য দেশের মুদ্রাকে নিজের দেশের মুদ্রায় রূপান্তর করতে হবে।’
তবে, এ বিষয়েও কিছু জটিলতা রয়েছে। যেমন, ভারত থেকে কেউ রুপি নিয়ে বিদেশে যেতে পারে না। কেউ বিদেশে গেলে সেই দেশটির মুদ্রা কিনতে হলে তাকে অবশ্যই প্রথমে রুপিকে ডলারে রূপান্তর করতে হবে।
এ ছাড়া একেক দেশের রয়েছে একেক রকম আর্থিক ব্যবস্থা ও বাণিজ্যনীতি। যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকা চীনের সঙ্গে বেশি বাণিজ্য করে এবং এক্ষেত্রে দেশটি চাইবে ইউয়ানের রিজার্ভ রাখতে, কিন্তু দেশটির অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদার পশ্চিমা বিশ্বের। সেক্ষেত্রে দেশটি চাইবে ডলারের পাশাপাশি রুবল বা ব্রাজিলিয়ান রেয়াইসের রিজার্ভও যেন তার থাকে।
ডলারের আধিপত্য থাকবেই
ব্রিকসে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত অনিল শুকলাল বলেন, ‘আমরা বহু মেরুর সমাজে বাস করতে চাইছি, একটি বহু মেরু কেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থায়।’ আর এক্ষেত্রে তিনিসহ ব্রিকসের অন্যান্য নেতারা মনে করেন, ডলারের বিকল্প তৈরি করাটা হবে সাধারণ কথায় বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার কাঠামোকে পরিবর্তন করার মতো প্রচেষ্টা।
এ প্রসঙ্গে শুকলাল বলেন, ‘১৯৭০, ৮০ বা ৯০ দশকে যারা বিশ্ব বাণিজ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ছিল তাদের সময় শেষ, সেই যুগটাই শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন পছন্দ করছি বহুমেরু কাঠামো। একটি বহুমেরু ভিত্তিক আর্থিক বিশ্ব ব্যবস্থা। আমরা এখন আর একটি বা দুটি মুদ্রাকে নিজেদের পছন্দের তালিকায় রাখতে পারছি না।’
শুকলাল উল্লেখ করেন প্যান-আফ্রিকান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনার কথা। এর আওতায় এক মহাদেশে আন্তসীমান্ত বাণিজ্যে সরাসরি লেনদেনের সুযোগ রয়েছে। তার মতে এই মডেল অনুসরন করা যেতে পারে। এর ফলে সুইফট ব্যবহার করার জন্য যে লেনদেন ফি দেওয়া হতো তা থেকে বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতে পারে।
তবে, এখনও বিশ্লেষকরা বলছেন অনুমিত ভবিষ্যতে ডলার রাজত্ব করেই চলবে। ওয়েফারের মতে, আমরা ডলারের একচেটিয়া প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে যুগ যুগ পিছিয়ে আছি। তার মতে, ব্রিকস যতি আলাদা মুদ্রা চালু করে, তবে তা হবে ইউরোর মতো, যা কিনা ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। আর তেল বা অন্যান্য পণ্যে রেফারেন্স মূল্য হিসেবে ডলারের আধিপত্য থেকেই যাবে।