ম্যানিনজাইটিস থেকে হতে পারে প্যারালাইসিস
মস্তিষ্কের পর্দার সংক্রমণকে সাধারণত ম্যানিনজাইটিস বলা হয়। এটি বেশ গুরুতর একটি অবস্থা। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৩০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ ওয়াহিদুর রহমান।
তিনি ডেল্টা মেডিকেল কলেজের নিউরো মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ম্যানিনজাইটিস কী?
উত্তর : মস্তিষ্কের কতগুলো পর্দা রয়েছে। একে ইংরেজিতে বলা হয় ম্যানিনজেস। এই পর্দাগুলোর সংক্রমণ হলে একে বলে ম্যানিনজাইটিস। পর্দা রয়েছে তিনটি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়, ডুরামেটার, এক নয়েডমেটার, পায়োমেটার। এই পর্দার যেকোনো একটিতে অসুবিধা হলে একে ম্যানিনজাইটিস বলা হয়।
প্রশ্ন : মস্তিষ্কের এই পর্দার সংক্রমণ কেন হয়?
উত্তর : সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে সংক্রমণ হয়। অন্যান্য জিনিস দিয়ে হতে পারে। তবে সাধারণত আমাদের দেশে যেসব জীবাণু রোগ তৈরি করে : পায়োজনিক অরগানিজম ব্যাকটেরিয়া, টিউবারকোলোসিস এগুলো থেকে হতে পারে। অথবা ভাইরাস থেকে হতে পারে। এই তিন ধরনের রোগজীবাণুর সংক্রমণে এই রোগ হয়।
প্রশ্ন : কারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে?
উত্তর : সব বয়সের, সব লোকেরই হতে পারে। এখানে ছেলেমেয়ে বা বয়সে তেমন কোনো তারতম্য নেই। তবে যাদের বয়স কম যেমন বাচ্চাদের, আবার যাঁদের বয়স বেশি অর্থাৎ বয়স্কদের হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। কারণ এঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আগে থেকে কম থাকে। এঁদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
প্রশ্ন : ম্যানিনজাইটিসের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ রয়েছে কি?
উত্তর : লক্ষণ হলো, প্রথমে জ্বর হয়। এর সঙ্গে বমি হতে পারে। মাথাব্যথা এবং ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া। এই চারটির মধ্যে এক বা একাধিক উপসর্গ যদি থাকে, তাহলে ম্যানিনজাইটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও বড় উভয়ের ক্ষেত্রে একই ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। তবে সবগুলো যে থাকবে, তেমন কোনো কথা নেই। হয়তো কোনোটি থাকল বা কোনোটি থাকল না। এই চারটির মধ্যে দুই বা ততোধিক থাকলে একে ম্যানিনজাইটিস বলে মনে করা হয়।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে রোগীরা কি জাতীয় অভিযোগ নিয়ে আসে?
উত্তর : প্রথমে জ্বর নিয়ে আসে। একদিন, দুদিন জ্বরের পরে হয়তো বমি শুরু হলো। এরপর তীব্র মাথাব্যথা থাকে। আমরা যখন পরীক্ষা করে দেখি, তখন দেখতে পাই, ঘাড়টি খুব শক্ত হয়ে গেছে। খিঁচুনি হতে পারে এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এমনকি তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হয়।
প্রশ্ন : সঠিক সময় বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?
উত্তর : যদি জ্বর হয়, দেখা গেল সাধারণ চিকিৎসায় তিনদিন, পাঁচদিনে জ্বরটা ছাড়ছে না, তাহলে বোঝা গেল জ্বরের ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না বা যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সে ওষুধে কাজ হচ্ছে না। এরপর দেখা গেল জ্বরের সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা হচ্ছে। জ্বরও আছে, তার সঙ্গে মাথাব্যথা হচ্ছে। রোগীটার খিঁচুনি হচ্ছে। বা বমি শুরু হয়ে গেছে। তখন দেরি না করে দ্রুত হাসপাতাল বা চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। চিকিৎসক তখন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন অসুখটা আসলে কী? এটি একটি জরুরি অবস্থা। যদি ঠিকমতো চিকিৎসা হয় তবে রোগী ভালো হয়ে যাবে।
আর যদি অবহেলা করা হয়, রোগীর চিকিৎসা ঠিকমতো না হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, সঠিক ওষুধ না পড়ে এসব রোগী মরে যেতে পারে। আর মরে না গেলেও, এমন জটিলতা দেখা দেবে যে সারা জীবন সেই জটিলতা তাকে বহন করতে হবে।
প্রশ্ন : সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হলে কী কী জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে। শরীরের যেকোনো একটি অঙ্গ প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে। কথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চোখে দেখতে অসুবিধা হতে পারে। কানে শুনতে অসুবিধা হতে পারে।
প্রশ্ন : কী ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে আপনারা রোগটি সম্বন্ধে নিশ্চিত হন?
উত্তর : অনেক ধরনের পরীক্ষাই তো রয়েছে। তবে খুব প্রচলিত হলো একটি রক্ত পরীক্ষা করতে হয়, দেখা হয় রক্তে কোনো সংক্রমণ আছে কি না। এরপর তার ব্লাড কালচার করা যেতে পারে। দেখা হয়, কোন জীবাণু দিয়ে রোগটি হয়েছে। তার সিএসএফ, মেরুদণ্ডের যে হাড় রয়েছে, তার ভেতরে যে জায়গা রয়েছে। সেরিবুলাস স্পাইনাল স্পেস বলে একে। এর ভেতর সুই ঢুকিয়ে তরল বের করি। সেই তরলটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় আসলে এই অসুখটি হয়েছে।
প্রশ্ন : চিকিৎসা কীভাবে করেন?
উত্তর : এই সিএসএফ পরীক্ষা করে দুটো জিনিস পাওয়া যায়। একটি হলো অসুখটি ম্যানিনজাইটিস কি না? দুই নম্বর হলো, কোন জীবাণু দিয়ে এটি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে পয়জনিক ব্যাকটেরিয়া, টিউবারকুলোসিস ও ভাইরাস কোনটি দিয়ে হয়েছে এই পরীক্ষা করে পাওয়া যায়। পয়জনিক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে হলে এর ওষুধ দিয়ে দেব। টিউবারকুলোসিস দিয়ে হলে এর চিকিৎসা দিয়ে দেব। আর ভাইরাস দিয়ে হলে এর বিরুদ্ধে কিছু ওষুধ আছে। আর লক্ষণের ওপর নির্ভর করে কিছু চিকিৎসাও রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রশ্ন : কতদিন ধরে চিকিৎসাটি চলবে এটি নির্ভর করে কিসের ওপরে?
উত্তর : কোন জীবাণু দিয়ে সমস্যাটি হচ্ছে এর ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। যেমন : ভাইরাস দিয়ে হলে পাঁচ থেকে ছয়দিনের মধ্যে জিনিসটি ভালো হয়ে যায়। টিউবারকুলোসিস দিয়ে হলে ছয় থেকে নয় মাস চিকিৎসা করতে হয়। আর পয়জনিক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে যদি হয়, তাহলে সাত থেকে ১০ দিন চিকিৎসা করতে হয়।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন?
উত্তর: ভিড়যুক্ত পরিবেশে থাকলে, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকলে, আলো বাতাস কম আসে এমন ঘরে থাকলে হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এসব পরিবেশ এড়িয়ে যেতে হবে। আর যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম যেমন : বয়স্ক মানুষ, বাচ্চাদের বেশি হয়। আর যাদের ক্যানসার আছে, ডায়াবেটিস আছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাদের ক্ষেত্রে ওই সব পরিবেশে গেলে সমস্যা হয়ে যায় বেশি।
প্রশ্ন : শিশুদের জ্বরের সময় খিঁচুনি হলে তাৎক্ষণিকভাবে বাবা-মায়েদের কী করা উচিত?
উত্তর : তাৎক্ষণিকভাবে বাসায় কিছু করা কঠিন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ম্যানিনজাইটিস ছাড়া অন্য কারণেও খিঁচুনি হতে পারে। কাজেই ম্যানিনজাইটিস হয়েছে কি হয়নি, যারা মেডিকেলের লোক নয়, তাদের পক্ষে কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল। তাই নিয়ম হলো লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি থাকলে কাছের চিকিৎসক বা হাসপাতালের সাহায্য নিতে হবে। এ ছাড়া বাসায় তেমন কিছু করার নেই। তবে জ্বর যেন বেশি না বাড়ে সেদিকে খেয়াল করতে হবে। এই জাতীয় রোগে অবশ্যই হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। কারণ পরবর্তী যে কাজগুলো সেগুলো বাসায় করা যাবে না। যদি ঠিকমতো চিকিৎসা করা হয়, এটি ভালো হয়ে যাবে। আর ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে এটি খারাপ হয়ে যাবে। কাজেই ভালো হওয়া তো দরকার। বাসায় রাখা মোটেই ঠিক হবে না।