ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করবে হলিস্টিক পদ্ধতির চিকিৎসা
বর্তমানে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যধিগুলো বেড়ে চলছে। এসব রোগ প্রতিকারে ওষুধ তো খেতেই হবে, তবে হলিস্টিক পদ্ধতির চিকিৎসার মাধ্যমে ওষুধ খাওয়ার পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনা যায় এবং রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৩২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দাস। বর্তমানে দি অ্যালার্জি অ্যান্ড অ্যাজমা সেন্টারের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আছেন।
প্রশ্ন : হলিস্টিক পদ্ধতি বলতে আমরা কী বুঝি? অসংক্রামক রোগের মধ্যে কী কী পড়ে?
উত্তর : হলিস্টিক মানে হলো হোল বডি। আমাদের শরীরের তিনটি অংশ। আত্মা, মন ও শরীর। বাইরে থেকে কেবল শরীরকে দেখি এবং শরীরের আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি। ওষুধ দিয়ে আমরা শারীরিক উন্নতি করতে পারি। তবে আত্মা ও মনের কোনো উন্নতি করতে পারি না। এতে অসংক্রামক রোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ অনেক কম ছিল। দুই থেকে তিন শতাংশ। এখন থেকে সেটা বেড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চরক্তচাপ এসব অসংক্রামক ব্যাধি দিন দিন বেড়ে চলেছে। যদি প্রতিরোধ করতে হয়, তাহলে আমাদের ওষুধের পাশাপাশি আত্মা, মন ও শরীরের উন্নতি করতে হবে। যখন আমরা পুরো শরীরকে উন্নতি করতে পারব তখন ঠিক হবে। এই হলিস্টিক পদ্ধতিতে রোগগুলোকে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব।urgentPhoto
প্রশ্ন : এটিকে কেন আমরা হলিস্টিক বলছি? এই বিশেষ পদ্ধতিটির কার্যকারিতা কী?
উত্তর : হলিস্টিক মানে হলো সম্পূর্ণ শরীর। আমাদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ভালো স্বাস্থ্য তাকেই বলে, যখন শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে ও আত্মিকভাবে ঠিক থাকে।
মানে শুধু শারীরিক উন্নতি হলে হবে না। মানসিক উন্নতি কেবল ওষুধ দিয়ে সম্ভব নয়। এই জন্য আমাদের এই হলিস্টিক পদ্ধতি দরকার।
প্রশ্ন : কীসের মাধ্যমে এই পদ্ধতি করা হয়?
উত্তর : প্রথমে আত্মা। আত্মার উন্নতি করতে হয়, মেডিটেশনের মাধ্যমে। মনকে উন্নতি করতে হয়, কতগুলো নিউরোবিক বিষয়ের মধ্য দিয়ে। আর শরীরকে করতে হয়, কিছু যোগ ব্যয়াম, প্রাণায়াম, মেডিটেশন এগুলোর মাধ্যমে। আত্মা, মন ও শরীরের উন্নতি করতে পারলে অসংক্রামক রোগ বলতে যেগুলোকে বুঝি, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, মাইগ্রেন, লো ব্যাকপেন এগুলোকে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব।
প্রশ্ন : একটি ডায়াবেটিক রোগীকে আপনারা কীভাবে প্রতিকারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : বিজ্ঞান আমাদের দিন দিন অনেক উন্নতির পথে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সংক্রামক রোগগুলোর ক্ষেত্রে, যেমন কলেরা এখন নেই বললেই চলে। মিজেলস নেই, টিটিনাস নেই, হুপিং কফ নেই। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অসংক্রামক রোগ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ। এর অন্যতম কারণ হলো মানসিক চাপ। কারণ যত আমরা সভ্যতার দিকে এগোচ্ছি, যত আমার উচ্চ সমাজ মেনে চলি, দিন দিন আমাদের মানসিক চাপ বেড়ে চলছে। দ্বিতীয়ত হলো, আমরা কাজকর্ম খুব কম করি। তৃতীয় হলো, আমরা খাওয়াদাওয়া বেশি খাই। এসব কারণে আমাদের সমস্যাগুলো দিন দিন বেড়ে চলছে।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে আপনারা কী পরামর্শ দেন? আপনাদের বিশেষ ধরনের চিকিৎসাটা শুরু হয় কিসের মাধ্যমে?
উত্তর : ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ওষুধ যে খায় বা খাবে, সাথে তাকে কিছু ব্যায়াম করতে হবে। যেমন আপনারা জানেন, মানসিক চাপের সাথে কিন্তু ডায়াবেটিসের সম্পর্ক আছে। কারণ, মানসিক চাপের যে হরমোন এগুলো বাড়লে কিন্তু ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। যত ওষুধ খাওয়ানো হয় মানসিক চাপ যদি না কমানো হয়, হরমনের নিঃসরণ যদি না কমানো যায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
এই মানসিক চাপ কমানোর জন্য কতগুলো পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো মেডিটেশন। আবার মনের উন্নতি করার জন্য আমরা কিছু ব্যায়াম করাই, সেগুলো হলো, নিউরোবিক। আর শরীরের জন্য কিছু যোগব্যায়াম, প্রাণায়েম, আকুপ্রেশার এগুলো করি। এগুলো করলে ডায়াবেটিস আস্তে আস্তে কমে যায়।
প্রশ্ন : এই পদ্ধতিটি কতদিন ধরে চলতে থাকে?
উত্তর : আসলে এই পদ্ধতিটি কিন্তু আজকের নয়। এগুলো হাজার হাজার বছরের আগের চিকিৎসা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এই হলিস্টিক পদ্ধতিগুলো একটু ধামাচাপা পড়ে গেছে। এখন উন্নত বিশ্ব দেখছে ওষুধ দিয়ে এসব রোগগুলো নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।ওষুধের পাশাপাশি হলিস্টিক পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এই চিকিৎসা সারাজীবন করতে পারবে। কারণ, ব্যায়াম করতে তো অসুবিধা নেই। ধ্যান করতে তো অসুবিধা নেই।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এগুলোকে বলে অনিরাময়যোগ্য রোগ। এগুলো সারাজীবন থাকবে। যত দিন বেঁচে থাকবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এখন এসব পদ্ধতির মাধ্যমে যদি ওষুধ কম খেয়ে থাকা যায় তাহলে তো অনেক ভালো। আমার এমন অনেক রোগী রয়েছে, যারা ইনসুলিন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। যে রোগী বেশি কথা শুনে, যে নিয়মকানুন বেশি মেনে চলে- তার উন্নতিটা বেশি হয়। এর মানে জীবনযাপনের ধরনের একটি উপায় বলে দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন : কেমন সারা পাচ্ছেন বিষয়টিতে?
উত্তর : বেশ ভালো সারা পাচ্ছি। এখন দেখেন কারো যদি হার্টের রোগ হয়ে যায়, তার যদি পটুয়াখালিতে সমস্যা হয়, ঢাকায় আসতে আসতে সে হয়তো মারা যায়। আপনি জানেন উন্নত বিশ্বেও হার্ট অ্যাটাক হলে, এক চর্তুথাংশ রোগীই হাসপাতালে আসার আগে মারা যায়। আমাদের দেশে সব জায়গায় উন্নত সেন্টারও নেই। কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় রয়েছে। এখন বাংলাদেশে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ রোগীকেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় এই হলিস্টিক পদ্ধতির বিকল্প নেই। এই পদ্ধতি যদি শিখিয়ে দেওয়া যায় দুর্গম এলাকাতেও এটি করে সুস্থ থাকা সম্ভব।
প্রশ্ন : ফলোআপের জন্য আপনাদের কাছে কতদিন পর পর আসতে হয়?
উত্তর : মাঝে মাঝে আসবে। এক মাস, দুই মাস বা তিন মাস পরে আসবে।
প্রশ্ন : তখন আপনারা কী দেখেন?
উত্তর : আমরা দেখি ঠিকমতো তার পদ্ধতিগুলো চলছে কি না। তার উচ্চ রক্তচাপ কতটুকু কমেছে। তার লিপিড প্রোফাইল কতটুকু কমেছে। ইটিটি করা হয়। ইটিটি তো সবসময় করার দরকার পড়ে না। আগে সে পাঁচ মিনিট হাঁটলে কষ্ট পেত। এখন এক ঘণ্টা হাঁটলেও তার কষ্ট হয় না।
প্রশ্ন : খাবার-দাবারের কী তালিকা থাকে তাদের জন্য?
উত্তর : অবশ্যই তালিকা আছে। এখন আমরা ফাস্টফুড, জাঙ্ক ফুড খেতে অভ্যস্ত। এগুলো বাদ দিয়ে আমাদের প্রাকৃতিক খাবার খেতে হবে। যেমন : আগে ঢেঁকি ছাটা চাউল ছিল। এখন সব আঁশ জাতীয় খাবারগুলো আমরা বাদ দিয়ে দিচ্ছি। এতে আমাদের এই রোগগুলোর প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে।
খাবারের মধ্যে বিশেষ করে প্রাকৃতিক খাবার যেমন শাক খাবে, সবজি খাবে, মাছ খাবে- সবই খাবে। শুধু লাল মাংস, গরু, খাসি, ঘি ছানা এগুলো বাদ দিয়ে সবই খাবে।
এই যে আমরা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করি। মনের চাপ যতক্ষণ পর্যন্ত না কমানো হবে, এই উচ্চ রক্তচাপ কখনো নিয়ন্ত্রণে আসবে না। এই হলিস্টিক পদ্ধতির মাধ্যমে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে।
আমার এক রোগী রয়েছে, ওষুধ কোম্পানির জিএম। চারটি ওষুধ খাওয়ার পরও তার উচ্চ রক্তচাপ কমত না। এই পদ্ধতি নেওয়ার পর আজ প্রায় সাত আট বছর যাবৎ ওষুধ কম খাওয়া লাগে এবং অনেক সুস্থ আছেন। এ রকম অনেক রোগী রয়েছে।
এই পদ্ধতিটি অনেক আগের। হিন্দুদের মুনি-ঋষি পাহাড়ে বসে ধ্যান করতেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) হেরা গুহায় ধ্যান করেছেন। এর কারণ হলো, মস্তিষ্ককে যদি স্থির করা যায়, মানসিক চাপকে যদি কমানো যায়, মানসিক চাপের নিঃসরণ যদি কমানো যায়- এই রোগগুলো কমে যাবে।
সবকিছুর মূলে হলো মানসিক চাপ। একেই আগে কমাতে হবে। পাশাপাশি কিছু শারীরিক কাজকর্ম করতে হবে। ব্যায়াম করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে। মানে যেই তিনটি কারণে এই রোগগুলো হচ্ছে, মানসিক চাপ, কম কাজ করা এবং ফাস্টফুড খাওয়া- এগুলো পরিবর্তন করে দিলে রোগীর উন্নতি হবেই।