অবহেলার শিকার অটিস্টিক শিশুরা
আদিল (২০) শান্ত চেহারার মিষ্টি একটি ছেলে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চেহারার মধ্যে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। কথা বলতে গিয়ে অবাক হতে হয়। এত শুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ! কিছুক্ষণ আলাপের পর তার জ্ঞানের গভীরতার প্রমাণ মেলে। তবে যাই হোক, আদিল কিন্তু অটিস্টিক এক মানুষ।
প্রাচীন মিসরের ইতিহাসের খুটিনাটি বিষয় আদিলের পুরো ঠোঁটস্থ। এমন একটি প্রশ্ন করে আপনাকে অবাক করে দেবে যে সে প্রশ্নের উত্তর আপনি কোনোদিন কল্পনাও করেননি। তার সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পর পরই সে আপনাকে মিসর ও মমিদের সম্বন্ধে নতুন নতুন তথ্য দিয়ে আপনার বিস্ময় জাগিয়ে দেবে।
পেইন্টিং আদিলের প্রিয় একটি জিনিস। ছবি আঁকায় তার জুড়ি নেই। ছবি এঁকে সে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও যথেষ্ট নাম করেছে। ছয় বছর বয়সে মায়ের কোলে বসে প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসের রঙিন ছবির একটি বই দেখেই আন্দোলিত হয় সে। তখন থেকেই তুলি হাতে নেয় ছবি আঁকার জন্য। মাত্র নয় বছর বয়সে সে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্টচার্চ কলেজে আয়োজিত চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে। ২০০০ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যের অক্সনে তার একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়। ১৩ বছর বয়সে বাংলাদেশের ঢাকার আড়িয়াল সেন্টারে প্রথম একক প্রদর্শনী ও বেঙ্গল গ্যালারিতে দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়। ১৫ বছর বয়সে মিসরীয় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘ইজিপ্ট ইন দি আইজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন’ আন্তর্জাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় আদিলের ‘গোল্ডেন ক্লিওপেট্রা’ নামের জলরঙের পেইন্টিংটি প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজ হাতে তাকে স্বর্ণপদক উপহার দেন। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আদিলকে।
একের পর এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে দেশের মানুষের বাহবা কুড়িয়েছে। এমন সোনার ছেলে আদিল কিন্তু কোনো স্বাভাবিক শিশু নয়। সে একজন অটিস্টিক শিশু। কিন্তু অটিজম তার কাছে পরাজিত, পারেনি তার প্রতিভাবে রুদ্ধ করতে। অবহেলা নয়, যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে অটিস্টিক শিশুরাও যে দেশের সোনার ছেলে হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ আদিল। অথচ আদিলের মতো মেধাবী অটিস্টিক শিশুরা অবহেলায় বেড়ে উঠছে। এর পেছনে মূল কারণ প্রচারণার অভাব।
অটিজম নিয়ে এখনো অজ্ঞ দেশের বেশির ভাগ মানুষ। এমনকি অনেক চিকিৎসকরেই এ বিষয় নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই। এরা মানসিক প্রতিবন্ধী না হয়েও সমাজে পরিচিতি পায় বদ্ধপাগল বলে। এর প্রতিবন্ধী নয়, আসলে খুবই ট্যালেন্ডেড।
অটিজম নিয়ে ১৯৪০ সাল থেকে গবেষণা চলছে। তবে এ ব্যাপারে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এ রোগের কারণ আজও অজানা। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব থাকলেও কেউই তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। সম্প্রতি মনে করা হয়, জন্মের প্রথম কয়েক বছর মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায় দেখা দেয় অটিজম। অটিস্টিক শিশুরা সামাজিক আদান-প্রদান ও মৌখিক-অমৌখিক যোগাযোগ করে না, নিজেকে নিজের গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখে। অর্ধেক অটিস্টিক শিশু কথা বলতে পারে না, পারলেও ঠিকমতো মনের ভাব প্রকাশ বা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। এরা নিজের জামা পরা, খাওয়া, শৌচকর্মও নিজে নিজে করতে পারে না।
কিন্তু এরা যেকোনো একটি বিষয়ে পারঙ্গম। কেউ ভালো পারে ছবি আঁকতে আবার কেউ বা অঙ্ক, কেউ বা আবার সংগীতে। বেশ অমানবিক জীবন-যাপন করে এরা। না পারে নিজের কষ্টের কথা কাউকে জানাতে, না পারে কোনো প্রয়োজন-তাগিদ কাউকে বলে বোঝাতে। অন্যের সাহায্য ছাড়া এরা একেবারেই চলতে পারে না। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর এদের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। এদের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো জিনিস এদের বারবার করে শেখালে তা এরা শিখতে পারে। জামার বোতাম লাগানোটাও শেখাতে এদের কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। তবে ধৈর্য ধরে বারবার শেখালে এরা যেকোনো কিছু শিখে ফেলতে পারে। এমনকি কথা বলাও শিখতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ বা চিকিৎসার মাধ্যমে এদের সামাজিকভাবে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী বা একাকী নিজের কাজগুলো করার উপযোগী করা যায়।
কিন্তু আমাদের দেশে এ সম্বন্ধে প্রচরণা না থাকায় অভিভাবকরা রোগটিকে গুরুত্ব দেন না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলেই মেনে নেন। ফলে অটিস্টিক শিশুর বয়স বেড়ে যেতে থাকে। কমতে থাকে রোগের উন্নতি হওয়ার হার। একসময় সমাজে পাগল বলেই বিবেচিত হয়ে অমানবিক জীবন কাটাতে বাধ্য হয় নিষ্পাপ, নিরীহ অসহায় শিশুরা।
শিশু অটিস্টিক কি না, তা অভিভাবকদের জানা খুবই প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা শুরু করা দরকার। এ জন্য অভিভাবকদের শিশুর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এক বছর বয়সে চারটি আচরণকে অনুসরণ করে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি অটিস্টিক শিশুকে নির্ণয় করা যায়। এ চারটি হলো—চোখে চোখে না তাকানো, নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া, আঙুল দিয়ে কোনো কিছু না দেখানো ও তাকে কোনো কিছু দেখালে সেটি না দেখা।
দেশে অটিজমে ভোগা শিশুর সংখ্যা কত এ ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা কিন্তু একেবারেই কম নয়। দেশে এদের চিকিৎসার জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। দেশের অটিস্টিক শিশুদের এক শতাংশও চিকিৎসা পায় না। এদের জন্য নেই ভালো স্কুল। চিকিৎসা করার জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, ট্রেনার। যে কয়টা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের আসনসংখ্যাও সীমিত। চাইলেও কেউ ভর্তি হতে পারে না।
তবে এ সরকার অটিস্টিক শিশুদের জন্য বেশ কিছু কাজ করেছে। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র চালু করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন’ নামে একটি কেন্দ্র চালু করেছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে অটিজম শিশু নির্ণয় করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজে চলার মতো উপযোগী করে তোলার ব্যবস্থা নেই। তারপরও অটিস্টিক শিশুদের দীর্ঘদিনের অবহেলা ঘুচেছে। তবে এটা কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই নগণ্য। শুধু রোগ নির্ণয় করে তো লাভ নেই। এর সঠিক চিকিৎসা বা প্রশিক্ষণ না দিতে পারলে রোগ নির্ণয় করে লাভই বা হলো কি?
অটিস্টিক শিশুদের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রশিক্ষকদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হতে হয়। প্রতিটি শিশু আলাদা আলাদা ব্যাপারে আগ্রহী। কাজেই তাদের চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা আলাদা। উন্নত বিশ্বে প্রতিটি শিশুর জন্য একজন করে প্রশিক্ষক থাকেন। আমাদের দেশে প্রশিক্ষকের চরম সংকট। বেসরকারি যে কয়টা অটিস্টিক স্কুল আছে, তারা নিজেরা তাদের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকেন। এ ব্যাপারে সরকারকে আরো এগিয়ে আসতে হবে, সাহায্য করতে হবে।