সাত উপায়ে প্রতিরোধ করুন ক্যানসার
ক্যানসারের কথা শুনলেই আমরা আঁতকে উঠি। কিন্তু একটু সচেতন হলে ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, শুরুতে ক্যানসার নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যানসার সারিয়ে তোলা সম্ভব। ক্যানসার প্রতিরোধে মেনে চলুন কিছু পরামর্শ।
১. ধূমপান থেকে দূরে থাকুন
গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসারের যত কারণ জানা গেছে, তার মধ্যে ৩৩ ভাগই ধূমপান। এমন কোনো ক্যানসার নেই যার সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্ক নেই। বিশ্বে ১৩ লাখ লোক মারা যায় ফুসফুসের ক্যানসারে। বাংলাদেশে মোট ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ২৫ ভাগ। এ ক্যানসারের শতকরা ৯০ ভাগই ধূমপায়ী। সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ রকমের বেশি এমন পদার্থ থাকে, যা ক্যানসার তৈরি করতে পারে। অধূমপায়ীরা ধূমপায়ীদের মাধ্যমে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। পান-সুপারি, জর্দা, তামাকপাতা বাংলাদেশে মুখ, গলা ক্যানসারের অন্যতম কারণ। এ ক্যানসার দেশের প্রধান পাঁচটি ক্যানসারের একটি।
২. খাবারে হোন সচেতন
খাদ্যাভ্যাস ক্যানসারের জন্য দায়ী বলে এরই মধ্যে গবেষকরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন জাপানে পাকস্থলীর ক্যানসার বেশি। কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেছেন, জাপানিরা আধা সেদ্ধ মাংস বা স্মোকড ফুড বেশি খায়। আবার ইরানে খাদ্যনালির ক্যানসার বেশি, তারা খুব গরম চা-কফি পান করে বলে। ফলমূল, শাকসবজি বেশি করে খেলে ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। খাবারের বেশির ভাগ অংশই উদ্ভিদজাত হওয়া উচিত। চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা দরকার। পোড়ানো ও ঝলসানো খাবার খাবেন না। ভিটামিন-সি ও ই খান। এগুলো কোষকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। পেয়ারা, আমলকীসহ বেশির ভাগ টকজাতীয় ফল ও মরিচে ভিটামিন-সি পাওয়া যায়। ভিটামিন-ই পাওয়া যায় আমন্ড বাদাম, চিনাবাদাম, শালগম, ওলকপির পাতা এবং গমবীজ দিয়ে তৈরি তেলে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি একসঙ্গে সেবন করলে কোলন ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদানের একটি হচ্ছে সেলেনিয়াম, যার অল্প পরিমাণ উপস্থিতি কোলন ক্যানসার ও ফুসফুস ক্যানসারের জন্য দায়ী কোষকলা ধ্বংস করে। এ উপাদান আখরোট ও অন্যান্য বাদামজাতীয় জিনিসের মধ্যে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, মদপান করলে স্তন ক্যানসার, অন্ত্রের ক্যানসার, ফুসফুস, বৃক্ক বা কিডনি, যকৃত ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ।
চার ভাগ ক্যানসারের জন্য দায়ী মদ্যপান। যত বেশি পরিমাণে ও বেশি দিন ধরে মদপান করা হবে, ততই বাড়বে এ ঝুঁকি। তাই মদপান থেকে সাবধান।
৩. ওজন রাখুন নিয়ন্ত্রণে
হাল সময়ে স্থূলতার হার বেড়ে গেছে। বেড়েছে ক্যানসারের ঝুঁকি। গবেষকরা জানিয়েছেন, স্থূলতার কারণে গোটা বিশেক ক্যানসার হতে পারে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো স্তন ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসার, ফুসফুস ক্যানসার, অন্ত্রের ক্যানসার, কিডনির ক্যানসার। শারীরিক পরিশ্রম না করা, বেশি পরিমাণে ফাস্টফুড খাওয়া স্থূলতার জন্য দায়ী।
৪. রোদ থেকে দূরে থাকুন
প্রতিরোধযোগ্য ক্যানসারের মধ্যে ত্বকের ক্যানসার অন্যতম। রোদের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ত্বকের জন্য হুমকি। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রোদে এ রশ্মি বেশি পরিমাণে থাকে। এ সময় রোদে বের হবেন না। বের হলেও সানস্ত্রিন লাগান। সানস্ক্রিনের সান প্রোটেকশন ফ্যাক্টর যেন ৩০-এর বেশি হয়। ব্যবহার করুন ছাতা বা স্কার্ফ। সানগ্লাসে ঢাকুন চোখ। ফ্যাশনের সঙ্গে সঙ্গে এটি চোখকেও রক্ষা করবে। সুতি ঢিলেঢালা, সাদা ও উজ্জ্বল রঙের পোশাকে পুরো শরীর ঢেকে দিন। এতে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যাবে। অক্ষত রাখবে আপনাকে।
৫. টিকা নিন
ভ্যাকসিন ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যকৃতের ক্যানসারে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ লোক মারা যায়। এদের অর্ধেকই মারা যায় হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে সৃষ্ট যকৃতের ক্যানসারের কারণে। ১৯৯২ সালে চীনে এক কোটি ২০ লাখ লোক হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাসের কারণে চীনে ক্যানসারের তালিকায় প্রথমে ছিল যকৃত ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) চীনে এ ভাইরাসের টিকা ব্যাপকভাবে চালু করে। এখন চীনে যকৃত ক্যানসার কমে গেছে অনেকাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, তিনটি টিকা দেওয়ায় বিশ্বব্যাপী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। তবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগেই এ ভ্যাকসিন নেওয়া দরকার, এতে ভ্যাকসিন ভালো কাজ করে। আমাদের দেশে ৪৫ বছর পর্যন্ত টিকা নেওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকরা সুপারিশ করেন।
৬. নিয়ন্ত্রণ করুন নিজেকে
অবাধ ও অরক্ষিত যৌনাচারের কারণে এইচআইভি-এইডস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, হেপাটাইটিস বি, সি ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে। এ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন। অন্যের ব্যবহৃত সুচ ব্যবহার করবেন না।
৭. ক্যানসার নির্ণয় করুন শুরুতেই
স্তন ক্যানসার, জরায়ুমুখ ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসার, ত্বকের ক্যানসার, কোলন ক্যানসারসহ আরো অনেক ক্যানসারই আছে, যেগুলো শুরুতে নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব। এ ক্যানসারগুলো নির্ণয়ে সচেতন হতে হবে আপনাকেই। নিজেই মাসে একবার নিজের স্তন পরীক্ষা করুন। অস্বাভাবিক কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।