‘রানওয়ে’ সিনেমা নয়, বাস্তব
কোনো সিনেমা যখন বাস্তব কাহিনীর ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে, তখন সেটাকে সাধারণত বাস্তবধর্মী সিনেমা বলে। এ ধরনের সিনেমার কাহিনী সংগ্রহ করা হয় চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে। সংগ্রহ করা ঘটনাকে চিত্রনাট্যের ছাঁচে ফেলে একটা গোছানো কাহিনী আকারে দাঁড় করানো হয়। তবে বাস্তবধর্মী সিনেমা নির্মাণ একটি চ্যালেঞ্জের কাজ। কেননা, অনেক সময় এ ধরনের সিনেমায় পরোক্ষভাবে সত্য কথা বলা হয়। কখনো কখনো সত্য অনেক বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সবাই এই সত্য বলার সাহস করে না বা করতে চায় না। যাঁরা করতে চায়, তাঁরা সাহসী নির্মাতা। সে ক্ষেত্রে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদকে সাহসী বলে অভিহিত করলে নেহাত ভুল হবে না। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যত চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন, সবকটির কাহিনীর উপাদান ছিল সমাজ, সামাজিকতা, সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। সিনেমাকে যদি সমাজের আয়না হিসেবে ধরা হয়, তাহলে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র সেই আয়নার প্রতিবিম্ব।
‘রানওয়ে’ তারেক মাসুদের অন্যতম একটি বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র। প্রায় ৯০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রে তিনি সুনিপুণভাবে ২০০৫-০৬ সালের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেন। চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে কাহিনী থেকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
গল্পের নায়ক রুহুল। বেকার। মাদ্রাসা থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থী। এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশে মা, বোন আর দাদাকে নিয়ে থাকে। মামার দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে। বাবা মধ্যপ্রাচ্যে থাকলেও খোঁজখবর নেই। মা এনজিও থেকে লোন নিয়ে আর গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালায়। আর ছোট বোন গার্মেন্টে কাজ করে। মামার কম্পিউটারের দোকানে ঘটনাক্রমে আরিফ নামের এক ধর্মান্ধ যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে তাকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ভুল পথে নিয়ে যেতে চায়। আরিফ সফলতার সঙ্গে রুগুলের মানসিকতা পরিবর্তন করে ফেলে। একসময় রুহুলকে জঙ্গি ট্রেনিংয়ে নিয়ে যায় আরিফ। ট্রেনিং শেষে রুহুল জঙ্গি চক্রের নির্দেশমতো সিনেমা হলে বোমা হামলা করে। একটা সময় পর রুহুল দ্বিধায় পড়ে যায়। আলো আর অন্ধকার পথের তফাৎ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।
এই হলো সংক্ষেপে ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রের কাহিনী। চলচ্চিত্রটি দেখে ক্ষণিকের জন্য তারেক মাসুদকে ইসলামবিদ্বেষী মনে হতে পারে। তবে একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি ধর্মের লেবাসে থাকা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এখানে তিনি কাহিনী বলার ক্ষেত্রে আগ্রাসী হননি। নম্রভাবে তিনি এসব বিষয় তুলে ধরেছেন।
তারেক মাসুদের গল্প বলার ধরন অন্য যেকোনো পরিচালকের থেকে আলাদা। তিনি কখনো কল্পনায় ভেসে বেড়াতেন না বা কল্পনাকে প্রশ্রয় দিতেন না। এটি তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ। বাস্তবে বিচরণ করতে ভালোবাসতেন বিধায় তিনি বাস্তববাদী পরিচালক।
‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রটির কাহিনী নিয়ে যদি আরো বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে, তিনি এতে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন।
প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা সুখকর নয়। নানাভাবে তারা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। বেতন বৈষম্যের স্বীকার হয়ে চাকরি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসছে। এমন অবস্থায় রুহুলের বাবা কয়েক মাস আগে জায়গা-জমি বিক্রি করে পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন এনজিও ক্ষুদ্রঋণের নামে গরিবদের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ নেয়। এই সুদ টানতে টানতে আসল টাকাটাই শোধ করা হয় না। চলচ্চিত্রটিতে রুহুলের মা এমনই এক এনজিও থেকে ঋণ নেয়। সঠিক সময়ে কিস্তির টাকা দিতে না পারায় নানা রকম কথা শুনতে হয়।
তৃতীয়ত, পুঁজিবাদের চোখ রাঙানিকে তিনি তোয়াক্কা না করে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, রানওয়েতে দাঁড়িয়ে একটি শিশু প্লেনের দিকে গুলতি তাক করে আছে। তার মুখায়বের আকৃতি বলে দেয়, সে গুলতি দিয়ে প্লেনকে উড়িয়ে দিয়ে পুঁজিবাদের শিকড় উপড়ে দিতে চায়।
এ ছাড়া খুঁটিনাটি অনেক বিষয় চলচ্চিত্রটিতে তুলে ধরা হয়েছে, যা সত্যিই ভাবুক সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। ভালো-খারাপের পার্থক্য বুঝতে শেখায়।
‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তারেক মাসুদ যে দৃশ্যগুলো তুলে ধরতে চেয়েছেন, তা খালি চোখে খুব একটা বোঝা যাবে না। যে কথাগুলো তিনি বলতে চেয়েছেন, খুব গভীরে না গেলে সেগুলোর মর্মার্থ বোঝা সম্ভব হবে না। অনেকে অভিযোগ করেন, তারেক মাসুদ ছবিতে ইসলাম ধর্মকে হেয় করেন। অথচ তাঁদের এই ধারণা কিন্তু বড় রকমের ভুল। তিনি সব সময় উগ্র ধর্মান্ধতার বিপক্ষে ছিলেন। তা ছাড়া তিনি নিজেই একজন মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। সে জন্যই তাঁর প্রায় ছবিতে মাদ্রাসাছাত্রের প্রতি কোমলতা লক্ষ করা গেছে।
এবার চলচ্চিত্রটির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। তাঁরা কেমন অভিনয় করেছেন, সে সম্পর্কে একটা ধরণা দিতে চাই আমার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রটিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা কিন্তু খুব একটা পরিচিত মুখ নন। যদিও নাজমুল হুদা ও তিশা পরিচিত মুখ। সবাই খুব সাবলীলভাবে নিজ নিজ চরিত্র তুলে ধরেছেন। মনে হয়েছে, তাঁরা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেছেন। তাই এতটা বাস্তবমুখী মনে হয়েছে। অতিথি শিল্পী হিসেবে তিশার উপস্থিতি ছবিটিকে ভিন্নমাত্রা দান করেছে। তবে অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে অভিনয় আদায় করে নেওয়ার কৃতিত্ব তারেক মাসুদকে দিতে হবে। অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে অভিনয় বের করে নেওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না।
অভিনয় ছাড়াও চলচ্চিত্রটির আবহ সংগীত, ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসহ ক্যামেরার কাজে মুন্সিয়ানার ছাপ ছিল। মিশুক মুনীরের করা ক্যামেরাওয়ার্ক, ফ্রেম সব সময়ই জীবন্ত। তারেক মাসুদকে ‘সিনেমার ফেরিওয়ালা’ বলা হলে মিশুক মুনীর ‘ক্যামেরার কবি’।
এখন কথা হলো, ‘রানওয়ে’ কোন ধরনের ছবি? স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। কারণ, ছবিটি দেখার সময় এটাকে ‘আর্ট ফিল্ম’ কিংবা ‘বাণিজ্যিক ফিল্ম’ কোনো কাতারেই ফেলা যাবে না। এটা একটি বড় সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তারেক মাসুদ নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রানওয়ে’র শরীরে আমি কখনো তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’-এর ট্যাগ লাগাতে চাই না। এই ফিল্ম গুটিকয়েক বোদ্ধা দর্শকের জন্য নির্মিত হয়নি। এই ফিল্ম গণমানুষের ফিল্ম।
তারেক মাসুদ সিনেমায় গণমানুষের কথা বলতেন। এই গণমানুষের কথা গণমানুষের কাছেই পৌঁছে দিতে তিনি শহর থেকে শহরে ছুটে বেরিয়েছেন। সিনেমা ফেরি করেছেন। কেননা, তাঁর ছবি প্রদর্শন করতে মাল্টিপ্লেক্স এবং সিনেমা হল ব্যবসায়ীরা কখনোই আগ্রহী ছিল না। সে কারণেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ‘সিনেমার ফেরিওয়ালা’।