মেরুদণ্ডের সমস্যা ও সার্জিক্যাল চিকিৎসা
মেরুদণ্ডে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। কোমর ব্যথা, পিঠ ব্যথা থেকে শুরু করে কোমরে টিবি বা যক্ষ্মাও হতে পারে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৫০৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. হোসেন। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : মেরুদণ্ডে সাধারণত কী কী সমস্যা হয়? এবং এর কোনগুলোর ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে?
উত্তর : মেরুদণ্ডের যে সমস্যাগুলো নিয়ে রোগীরা চিকিৎসকদের কাছে আসেন, এর মধ্যে প্রধানত আসে কোমরে ব্যথা নিয়ে। এর পর বলেন ঘাড়ে ব্যথা, পিঠে ব্যথা এসব সমস্যার কথা। বেশিরভাগ এই কোমরে ব্যথা বা ঘাড়ে ব্যথা সাধারণ ব্যথা। এগুলোর জন্য যদি চিকিৎসা করি তা-ও ভালো হয়, যদি চিকিৎসা নাও করি বিশ্রাম নিলে ভালো হয়। এগুলোর ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণ থাকে। কোমরে ব্যথার সঙ্গে পায়ে ব্যথা হয়, কোমরে ব্যথার সঙ্গে প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধ হয়। কোমরে ব্যথার সঙ্গে পা অবশ হয়ে যায়, হাঁটতে পারে না। তখনই একে বলে রেড সাইন। তখন আমাদের চিন্তা হয়, এই রোগীর কোনো ডিস্ক প্রলাপস হলো কি না। এই রোগীর মেরুদণ্ডে টিউমার হলো কি না, এই রোগীর সংক্রমণ হলো কি না বা অন্য কোনো কিছু হলো কি না। তখন আমরা এমআরআই করে রোগ নির্ণয় করার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : রোগ নির্ণয় করার পর করণীয় কী?
উত্তর : এ ধরনের সমস্যা হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সার্জন হিসেবে আমাদের কাছে এ ধরনের রোগী এলে আমরা তাকে ভালোভাবে দেখে নির্ণয় করার চেষ্টা করি, সমস্যাটি কেন হয়েছে। অনেক সময় নন-মেডিকেল কারণ যদি হয়, আমরা একে ওষুধপত্র দিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করি। আর যদি মনে হয়, না কোনো সার্জিক্যাল রোগ হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে একটি সাধারণত এক্স-রে করি। এক্স-রেতে না বোঝা গেলে পরে এমআরআই, সিটি স্ক্যান করে কারণ নির্ণয় করি। ডিস্ক প্রলাপসের ক্ষেত্রে এক মাস কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিই। যদি ভালো না হয়, তখন হয়তো আমরা অস্ত্রোপচারের কথা বলি। এই ডিস্ক প্রলাপসের বিভিন্ন রকমের অস্ত্রোপচার আছে, আমরা আগে চার-পাঁচ ইঞ্চি ইনসেশন দিয়ে অনেক বড় কেটে অস্ত্রোপচার করতাম। এখন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে এক ইঞ্চি ইনসিশন দিয়ে করি। সকালে অস্ত্রোপচার করে বিকেলে ছেড়ে দিই। ১ দশমিক ২ সেন্টিমিন্টার আমরা ক্যামেরা ঢুকাই। এটা এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করে এক ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে পারি। এটা হলো ডিস্ক প্রলাপসের ক্ষেত্রে। আর স্পাইনাল টিউমার যদি হয়, টিউমারের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ছাড়া কোনো গতি নেই। আমরা অস্ত্রোপচার করতে বলি, দ্রুত অস্ত্রোপচার করে নেওয়ার চেষ্টা করি। আর যদি দেখা যায় যে কোমরের হাড় কোনো কারণে ভেঙে গেছে, তখন অস্ত্রোপচার করে।
প্রশ্ন : আর যদি টিবি হয়?
উত্তর : আর যদি টিবি হয়, এ ক্ষেত্রে আমরা খেয়াল করি যে এটা মেরুদণ্ডের স্থিতিস্থাপকতা ঠিক আছে কি না। যদি স্থিতিস্থাপক হয়, তাহলে আমরা টিবির ওষুধ দিয়ে রোগীকে শুয়ে থাকতে বলি। তখন রোগী আস্তে আস্তে ভালো হয়। যদি ভার্টিব্রাকে খেয়ে ফেলে, তখন এটাকে ঠিক করে দিই।
প্রশ্ন : এই রোগীদের অস্ত্রোপচার পরবর্তী জীবনযাপনের পরিবর্তন কতখানি দরকার?
উত্তর : যাঁরা ডিস্ক প্রলাপস নিয়ে আসেন, অস্ত্রোপচার করলে হয়তো ভালো হয়ে যান। আমরা পরবর্তীকালে বলি, যাঁরা ভারী কাজ করেন, ওজন তোলেন, তাঁদের নিষেধ করি। এটি করবেন না। আপনারা অন্য পেশায় চলে যান। অথবা যাঁরা দীর্ঘ সময় অফিসে বসে কাজ করেন, তাঁদের বলি আপনারা এক ঘণ্টা বসে থাকলে, চার-পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড়াবেন বা হাঁটবেন। এসব রোগীকে বলি, আপনারা মেঝেতে বসবেন না বা শোবেন না। কমোড ব্যবহার করতে বলি। বলি যেন আগামীতে আবার এই রোগ না হয়। তবে যদি আবার টিউমার হয়, টিউমার হলে তাকে বেশি বাধা দিই না। যদি বিনাইন টিউমার হয়, তাহলে রোগী ভালো হয়ে যায়। তখন তার জীবনযাপন মোডিফিকেশনের অত বেশি প্রয়োজন হয় না। সবচেয়ে বেশি মোডিফিকেশন করতে হয় যাদের স্ক্রু ও রড দিয়ে ফিক্স করে দিই। তাদের ভারী কাজ করতে একদমই নিষেধ করি।
প্রশ্ন : এ ধরনের সার্জারিতে যে বাইরের জিনিস ব্যবহার করেন, শরীরের ভেতর বাইরের জিনিস ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, এটা ক্ষতি করতে পারে কি?
উত্তর : স্পেয়ার পার রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি। শরীরের যে অঙ্গটি নষ্ট হয়ে গেছে, যে হাড়টি নষ্ট হয়ে গেছে, যে অংশটি নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা বাইরে থেকে নিয়ে এসে দিতে হয়। আপনারা দেখেছেন, হার্টের মধ্যে স্ট্যান লাগানো হয়, কোমরের ক্ষেত্রে যে ভার্টিব্রা নষ্ট হয়ে যায়, কৃত্রিম জিনিস লাগানো ব্যয়বহুল। শরীরে এটি সংক্রমণ করে না। শরীর একে ভালোভাবে গ্রহণ করে।
প্রশ্ন : একজন মানুষের টিবি হলে কী করে থাকেন?
উত্তর : দেখুন, রোগটি টিবি। টিবির যে চিকিৎসা, সেটা আমাদের দিতেই হবে। তবে এই অ্যান্টিটিউবারকুলার ওষুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে, ফুসফুসের টিবির ক্ষেত্রে আমরা ছয় মাস বা নয় মাসের ওষুধ দিই। তবে হাড়ের টিবি যদি হয় বা মস্তিষ্কের টিবি যদি হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা ১৫ মাস বা ২৪ মাস বা আরো বেশিদিন দিতে পারি। এ জন্য সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, অনেক সময় ওষুধ লিখে দিই। আপনি ২৪ মাস ওষুধ খাবেন, তারা খেতে চায় না। বা অনেকে মনে করেন, ডাক্তার সাহেব কি ভুল করে দিলেন কি না? বা এত দিন খেলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে কি না। আরেকটি হলো ফিক্সিজন করে ফেলা। যে যন্ত্রটি লাগিয়ে দেওয়ার কথা, সেটি অস্থিতিস্থাপক হয়, এটাও করতে হবে। টিবির ওষুধও দিতে হবে। সার্জারির প্রয়োজন হলে করতে হবে। তবে টিবির যে চিকিৎসা, সেটা করতেই হবে।