তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে করণীয়
তামাক মানবদেহে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। তামাক গ্রহণ বন্ধে সচেতনতা দরকার। এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৭৫৫তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা ও অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন।
অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা বর্তমানে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেশিয়াল বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত এবং অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
এনটিভি : তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কী করণীয়?
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন : ২০০৩ সালে আমার একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার মনে হয় জীবনে এই ধরনের অভিজ্ঞতার সাধারণত সুযোগ হয় না। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের দল হিসেবে আমরা জেনেভাতে, ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোলের জন্য আলাপ-আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সভাপতিত্ব করেছিল। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনেক সুনামও কুড়িয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তামাকের বিভিন্ন আইন আমাদের জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল। তো আমার সৌভাগ্য ছিল আমি সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বাংলাদেশে কিছু গবেষণা ছিল। এর মধ্যে গ্লোবাল এডাল্ট টোবাকো সারভে একটি। এতে বাংলাদেশ প্রথম কাতারের একটি দেশ। এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে পরবর্তী অনেকগুলো নিয়মকানুন নীতিমালা এসেছে। আমরা কোথায় খেতে পারব, কোথায় খেতে পারব না, অর্থদণ্ড থেকে নানা ধরনের বিষয় এসেছে।
এনটিভি : মুখের ক্যানসার বাড়ার প্রধান কারণ তো তামাক?
অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা : হ্যাঁ। আরেকটি বিষয় হলো পুষ্টির বিষয়। পুষ্টিহীন রোগী যদি তামাক গ্রহণ করে, সহজেই তাদের ক্যানসার হবে।
একটা বিষয় বলতে চাই, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেনের কথার প্রসঙ্গ ধরে, বাংলাদেশ হয়তো নীতিগতভাবে বলছে সে এসব করবে। তবে বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? গ্রামে দেখা যাচ্ছে, ধান চাষের পরিবর্তে এই টোব্যাকো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বেশি টাকা দিয়ে, তামাক তৈরি করতে সাহায্য করছে। আমরা সবাই জানি, সরকারও জানে। সরকার ও সবাই মিলে যদি আইনগতভাবে কিছু করা হয়, তাহলে প্রতিরোধ সম্ভব।
প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমি বলব, আমরা এই টিভি স্টেশনের বাইরে গেলে কী দেখতে পাব? একটি ভ্যানে হয়তো তামাক, পান এগুলো বিক্রি করছে। আমরা যদি প্রত্যেকে একে বর্জন করি, তখন কিন্তু আপনা আপনি জিনিসটি কমে যাবে।
এনটিভি : নীতিমালার প্রয়োগ কীভাবে সম্ভব?
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন : এর আগে আমি একটি কথা বলে নিতে চাই, দেখা যাচ্ছে, ধানক্ষেতে ধান না চাষ করে তামাক চাষ করছি, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে কিছু জায়গায় এটি বেশি পরিমাণে হয়। তামাক এতটাই ক্ষতিকর যে তামাকের মধ্যে প্রায় চার হাজার কণা থাকে। এর মধ্যে ৪৫০টি কণা ক্যানসারের সঙ্গে জড়িত। যখন এটি ফসল হিসেবে কোথাও করা হয়, জমির কেবল উর্বরাশক্তি নষ্ট হয় না, বছরের পর ব্ছর সেখানে ধান চাষ করাও সম্ভব হয় না। আইন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাঠামোগত দায়িত্ব অনেক। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের যেই আইনগুলো আছে, তার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দেওয়া আছে।
তামাকের কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে না। তামাকের যে বক্সগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে ক্যানসারের ছবি দিতে হবে। কেবল লেখা দিলে হবে না, সঙ্গে ছবি দিতে হবে। যাতে ছবি দেখে তারা বুঝতে পারে, এখানে কী হচ্ছিল। বাংলাদেশে এটি কিছুটা অনুসরণ করছে। পুরোপুরি যে করছে সেটি নয়। তবে কিছুটা মেনে চলছে। আরেকটি বিষয় হলো, পাবলিক প্লেস বা জনসমাগমস্থলে না খাওয়া। একজন লোক খাচ্ছে। তবে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শহর অঞ্চলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ করা হচ্ছে। তবে সুদূর গ্রামগঞ্জে যেভাবে করা দরকার সেভাবে করছে না। আইন একটি অংশ মাত্র। তবে সচেতনতা বিরাট একটি ব্যাপার।
অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা : সামাজিকভাবে, পরিবারের সঙ্গেও যদি আমরা একে বুঝে সবার সঙ্গে আলোচনা করি তাহলে ভালো হয়। যদি বাবা ধূমপান করে, মা পাচ্ছেন, বাচ্চারা পাচ্ছে। হয়তো এই বাচ্চাই বন্ধুবান্ধব পেলে বলে, ‘চল একটু সিগারেট খেয়ে দেখি কেমন লাগে’? অতএব ঘর থেকে যদি আমরা সচেতনতা না বৃদ্ধি করি তাহলে অসুবিধা।
আরেকটি জিনিস আমি খেয়াল করেছি গ্রামে যখন যাবেন বেশির ভাগ লোক তো দরিদ্র, তারা একজন অতিথি আসলে একটি পান দেন। এরপর সুগন্ধিওয়ালা কোনো সুপারি বা জর্দা দেন। অতএব আমাদের দেশের লোকজনকে যদি অথনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না করতে পারি, তাহলে অসুবিধা। এটি বোঝানোর বিষয়ে আমাদের নিজস্ব ও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে।
আমাদের ওরাল ক্যানসার সোসাইটি আছে। প্রতিবছর আমরা গ্রামে গিয়ে ক্যানসার স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করে থাকি। সেখানে যেসব রোগীকে রোগাক্রান্ত ধারণা করা হয়, তাদের চিঠির মাধ্যমে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসায় সহায়তা করি। এর চেয়ে এখন বেশি প্রয়োজন প্রতিরোধ।
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন : এসব কমানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। সামাজিক আন্দোলনের জন্য স্কুলে, কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে পারি। স্কুল-কলেজে যদি লোকজন এগিয়ে আসে, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা যদি দায়িত্ব নেন, তাহলে ভালো হয়। সমাজে কিছু মানুষ আছেন ওপেনিয়ন লিডার। যাঁরা পরামর্শ দেন। যেমন : স্কুল টিচার। কারণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের দেখে শেখে। যেমন : মসজিদের ইমাম। মসজিদের ইমাম সাহেব যদি মসজিদে গিয়ে কথা বলেন, সে কথা অনেক মুসল্লি শুনে থাকেন।