প্যালিয়াটিভ কেয়ার ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
রোগীর রোগ নিরাময় সম্ভব না হলে এবং রোগী মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেলে বা জীবনের অন্তীম সময়ে পৌঁছে গেলে তখন তার যে সেবা তাকে প্যালিয়াটিভ কেয়ার বলা হয়। বাংলাদেশে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের অবস্থা কেমন?
এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮৩৮তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. মো. নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে প্যালিয়াটিভ কেয়ার এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে? বা আপনি কীভাবে শুরু করলেন, প্রেক্ষাপট যদি একটু বলেন।
উত্তর : বাংলাদেশে এর শুরুটা অনেকদিন আগে। ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছোট ঘরে এর যাত্রা শুরু। ২০১১ সালে তৎতকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিল্লুর রহমান সাহেব। উনি উদ্বোধন করলেন সেন্টার ফর প্যালিয়াটিভ কেয়ার। ২০১৫ সালে একে স্পেশালিটি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। ২০১৬ সালে এমবি ইন প্যালিয়াটিভ মেডিসিন পাঁচ বছরের কোর্স রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম শুরু হলো। এর মানে বেশ অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে।
প্রশ্ন : যেসব রোগীর আরোগ্য সম্ভব নয়, সেসব রোগীর সেবা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে কোন পর্যায়ে রয়েছে ? কোথায় কোথায় কোন পর্যায়ে আছেন আপনারা?
উত্তর : সেবা দেওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু এখনো অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে। আপনি যদি প্রয়োজনের দিকে একটু লক্ষ করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে বাংলাদেশে প্রায় ছয় লাখ লোকের এই সেবার প্রয়োজন পড়ে। এই সেবাটি আসলে একটি সম্পূর্ণ সেবা। টোটাল কেয়ার বলি আমরা। আমরা বলি যে নিরাময় অযোগ্য মানুষ যখন জানেন যে তার জীবন ছোট হয়ে এসেছে, সীমিত হয়ে এসেছে তখন তার শরীরের কষ্ট যেমন লাঘব করা দরকার, তেমনি তাঁর মনের কষ্ট, আত্মার কষ্টটিও লাঘব করার প্রয়োজন পড়ে। সেই জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ শিক্ষা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে দুভাগ্যজনকভাবে আমাদের মেডিকেলের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট লেভেলে এই শিক্ষা প্রশিক্ষণের পরিসর অত্যন্ত সীমিত। তবে পার্শ্ববর্তী দেশই একে বাধ্য করে ফেলেছে। পৃথিবীর বহু দেশ বলছে যে প্যালিয়াটিভ মেডিসিনে প্রশিক্ষণ ছাড়া চিকিৎসক হওয়া যাবে না।
আপনি যদি নিরাপদ জন্মের জন্য উদগ্রীব হন, তাহলে আপনি নিরাপদ মৃত্যুর জন্য কেন চেষ্টা করবেন না। একটি নিরাপদ জন্মের জন্য রাষ্ট্র যদি সামনে এগিয়ে চলে আসে, তেমনি নাগরিকের নিরাপদ মৃত্যুর জন্য ব্যবস্থা কেন করবে না। বাংলাদেশের যদি ছয় লাখ লোকের এটি প্রয়োজন পড়ে, সেই তুলনায় আমরা গত বছর, মাত্র ১৬০০ বা ১৮০০ মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। কেন? কেবল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সুযোগটি রয়েছে। আর কোথাও ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। সবচেয়ে ভালোভাবে গড়ে ওঠার কথা ছিল আমাদের ক্যানসার হাসপাতালে, গড়ে ওঠার কথা ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
প্রশ্ন : এর সঙ্গে আপনারা কারা কারা যুক্ত থাকা আবশ্যক মনে করেন?
উত্তর : আগে একটি কথা বলে নিই। আপনি ও আমি চিকিৎসক হিসেবে নিজেরাও তো অসুস্থ হই। নিজেরাও দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হতে পারি। আমি হাসপাতালে ভর্তি হলে যে পরিচর্যাটি মনে মনে কামনা করি,প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেই পরিচর্যার কথাই বলে। তবে সমস্যা হলো আমরা তো সেই সংস্কৃতি তৈরি করছি না। তৈরি না করে আমি আশা করতে পারি না। এটি হচ্ছে প্রধান যুক্তি আমার।
দ্বিতীয়ত এটা কাদের কাজ? আসলে এর সঙ্গে পুরো সমাজ ব্যব্স্থাটা জড়িত। একটি মানুষের যখন বাসায় চালের অভাব থাকে, তার ছোট চারটা বাচ্চা না খেয়ে রয়েছে, তখন সমাজ সেই অসুস্থ মানুষটির দায়িত্ব নেবে। চিকিৎসক কেবল তার চিকিৎসার জায়গাটুকুর দায়িত্ব নেবে। একে প্যালিয়াটিভ মেডিসিন বলা যেতে পারে। তবে তার আধ্যাত্মিক কষ্টের বিষয়টি বা তার মানসিক কষ্টের ব্যাপারটি, তার কী হবে? সেই জন্য বিদেশে একটি শব্দ প্রচলিত হচ্ছে মমতাময় নগরী। যে নগরীতে সবাই জানবে যে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের আসলে কী কী প্রয়োজন।
আসলে এটি কাদের কাজ? এর সঙ্গে সমাজসেবকরা জড়িত। সবচাইতে বেশি জড়িত স্বেচ্ছাসেবকরা। এর সঙ্গে ধর্মীরা নেতারা জড়িত হতে পারেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী কে নয়? সবাই জড়িত হতে পারেন। একক ভাবে কারো পক্ষে সব সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।