আলমগীর কবিরের রচনা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র
ভূমিকা
দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকার ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিভাগে দুই কিস্তির এই লেখাটি পাঠিয়েছিলেন আলমগীর কবির (১৯৩৭-১৯৮৯)। এর প্রথম কিস্তি ছাপা হয় তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন পর—২৯ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে। অজ্ঞাত কারণে দ্বিতীয় কিস্তি ছাপতে পুরো এক বছর সময় নেয় ‘সংবাদ’। কবিরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর পরদিন—২১ জানুয়ারি ১৯৯০—তা আলোর মুখ দেখে।
আলমগীর কবিরের সর্বশেষ এই রচনাটি নেওয়া হয়েছে আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান এবং প্রিয়ম প্রীতিম পাল সম্পাদিত ‘আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহে’র প্রথম খণ্ড হতে। ‘চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি’ নামে বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করছে মধুপোক সম্পাদনা সংস্থা এবং আগামী প্রকাশনী। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি পাওয়া যাবে।
প্রথম কিস্তি
ঢাকার গুলশান মডেল টাউন অভিজাত পাড়া। দেশি উচ্চবিত্ত, বিদেশি দীর্ঘমেয়াদি আগন্তুক এবং অধিকাংশ কূটনৈতিক দূতাবাস ও কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। তদানীন্তন ঢাকা উন্নয়ন সংস্থার পরিকল্পনামাফিক গুলশানের বাসিন্দাদের উপযোগী বিপণিকেন্দ্র, পার্ক, কৃত্রিম হ্রদ, আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁসহ এলাকার উপযুক্ত স্থানে একটি সিনেমা হলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোন পর্যবেক্ষক যদি একদিন এই সিনেমাটির শো ভাঙার সময় উপস্থিত থাকেন তাহলে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা লক্ষ্য করবেন। দেখবেন শতকরা প্রায় একশ জন দর্শকই লুঙ্গির উপরে রং-বেরঙের হাওয়াই শার্ট পরিহিত। পা খালি অথবা প্লাস্টিক স্যান্ডেলে আবৃত। এদের সবার বসবাস গুলশান এলাকাবহির্ভূত পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে।
হলের ভেতরের অবস্থা করুণ। অপর্যাপ্ত আলো; ফইয়েরে চলতি ছবির ফটোসেট চুরির ভয়ে ছাদের কাছাকাছি লোহার নেটের পেছনে আটকে রাখা হয়েছে—ভাল করে দেখা যায় না। থিয়েটারের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। এখানে প্রতি সপ্তাহে যেসব ছবি দেখান হয় সেগুলো শৈল্পিক মান বিবর্জিত তথাকথিত বাণিজ্যিক বায়স্কোপ। সুতরাং গুলশানবাসীদের এই হলে এসে ছবি দেখার কোন কারণ নেই।
যে এলাকায় জমির বর্তমান বাজারদর বিঘাপ্রতি এক কোটি টাকার মত, সেখানে বহিরাগত নিম্নবিত্তদের জন্য এত বড় সিনেমা হল তৈরির পেছনে কোন পুঁজিবাদী যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে একটা কথা। এ এলাকার অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড কিন্তু অভিজাতদের উপযুক্ত শ্রীবৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। কেবল সিনেমাই বিপরীতমুখী। দোষ কিন্তু টাউন প্ল্যানারদের নয়। তাঁরা স্বপ্নেও ভাবেননি যে সিনেমা—যেটি তিরিশের দশক থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত সব শ্রেণির বিনোদন মাধ্যম হিশেবে প্রতিষ্ঠিত, সেটি—মাত্র পনের-বিশ বছরে নিজ শ্রেণিচরিত্র আমূল পাল্টে ফেলতে পারে।
বাণিজ্যিক ছবির নির্মাতা-দর্শকের যৌথ সহযোগিতায় রুচির ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় নিশ্চিত করে সিনেমা আজ এ দেশে মূলত এক প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ দেশে বলছি এজন্য যে পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তানেও দর্শকের শ্রেণিচরিত্রে এমন ব্যাপক পরিবর্তন আসেনি—যদিও বাংলাদেশের বিনোদন ছবির ধরন-ধারণ, চলন-বলন ও অন্যান্য চুটকি উপকরণ প্রধানত ‘বোম্বে’, কোন সময় ‘হীরামন্ডি’ সংস্কৃতিনির্ভর পাকিস্তানি ছবি থেকে ধার করা। কেন এমন হল—সেটাই এই নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়।
বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনা কলকাতায়। ত্রিশের দশকে সবাক ছবির আবির্ভাব এবং ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা বাংলা ছবিকে একটি বিশেষ চরিত্র প্রদান করে। সমকালীন বাংলা সাহিত্য ও নাটক তখন উৎকর্ষের চরম শিখরে। সেকালে কলকাতাসহ বিভিন্ন ‘চলচ্চিত্র রাজধানী’তে চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যবস্থা হলিউডি আদলে—অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে বিশাল পুঁজি এবং স্টুডিওভিত্তিক ব্যয়বহুল দৃশ্যগ্রহণ টেকনিকনির্ভর হয়ে—গড়ে উঠেছে। যদিও বিশের দশকে সোবিয়েত ইউনিয়নের এবং ফরাশি আভাঁগার্দ চিত্রনির্মাতারা স্টুডিওর বাইরে স্বাভাবিক নৈসর্গিক পরিবেশে অপেক্ষাকৃত স্বল্প ব্যয়ে যে চলচ্চিত্রায়ণ টেকনিক প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার কোন প্রভাব উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যায় না।
স্টুডিওভিত্তিক ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রের জন্য নির্ভরযোগ্য বাজার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কাজেই মাধ্যমগত এবং শিল্পমান সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ থাকে অত্যন্ত সীমিত। এজন্যই বাংলা ছবি ভীষণ রকমের জনপ্রিয় নভেল, গল্প ও নাটকনির্ভর হয়ে পড়ে। এমনকি স্বয়ং রবিঠাকুরও চলচ্চিত্রের এই চরম সাহিত্যনির্ভরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, চলচ্চিত্র সেদিনই সত্যিকারের শিল্পমাধ্যমে উন্নীত হবে যেদিন এই সাহিত্যনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
যা হোক, বাংলা ছবির এই বিশেষ চরিত্রটি এর মূল দর্শকশ্রেণির চরিত্র নির্ধারণে সহায়তা করেছিল। শিক্ষিত বাঙ্গালি মাত্রেই ছিলেন সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং তদানীন্তন আর্থসামাজিক কারণে এঁদের অধিকাংশই ছিলেন সকল স্তরের মধ্যবিত্ত [ শ্রেণি থেকে] উদ্ভূত। এঁরাই হলেন বাংলা ছবির মূল দর্শক। বাংলা উপন্যাসের আবেদন কদাচিৎ নিম্নবিত্তকে আকর্ষণ করত। এ কারণেই বাংলা ছবির দর্শকের মধ্যে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংখ্যা ছিল নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু তাঁরাও ছবি দেখতেন এবং বিপুল সংখ্যায়—বাংলা ছবি নয়, সুদূর বোম্বে বা লাহোরে নির্মিত ‘সর্বভারতীয়’ হিন্দি উদ্ভট ছবি, যেমন ‘হান্টারওয়ালি’ (১৯৩৫), ‘তুফান মেইল’ (১৯৩৪), ‘পাঞ্জাব মেইল’ (১৯৩৯), ‘শেখ চিল্লি’ (১৯৩০) প্রভৃতি। যখন শিক্ষিত বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত প্রমথেশ বড়ুয়া, মল্লিকা দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, যমুনা দেবী বা কাননবালাকে নিয়ে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছে, তখনই লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালি নিম্নবিত্তের স্বপ্নের দেব-দেবী হচ্ছেন [ফারহাত ইজিকিয়েল] নাদিরা, জন কেবাস প্রমুখ। কালে হিন্দি ছবির প্রভাব এমনই বৃদ্ধি পায় যে শিক্ষিত বাঙ্গালি দর্শকও প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তবুও মধ্যবিত্ত [ শ্রেণি] বাংলা ছবি এবং সামাজিক আখ্যানভিত্তিক হিন্দি ছবির প্রধান নিয়মিত দর্শক হিশেবে থেকে যায়।
নিম্নরুচির বাণিজ্যিক ছবিতে যাঁরা অর্থলগ্নি করেন বা যাঁরা এসব ছবির নিয়মিত প্রদর্শক তাঁরা কঠিন ব্যবসায়ী। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একমাত্র সেন্সর প্রথা ব্যতীত এঁদের বিরুদ্ধে অন্য কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এইসব জৈবিক বিনোদনসর্বস্ব ছবির একটা রাজনৈতিক দিকও আছে। সার্বিক নৈরাজ্য এবং হতাশার প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় ছবি গণ-আফিমের কাজ করে। তাই প্রত্যেক গণবিরোধী সরকার এসব ছবিকে রাজনৈতিক দোসর ভেবে পর্যাপ্ত নির্মাণ ও প্রচারের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে।
কিন্তু বাস্তববাদী, সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন চলচ্চিত্রের পর্যাপ্ত দর্শক যে এ দেশে আছে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। রুচিশীল দর্শক চলচ্চিত্র ছেড়ে টিভি বা ভিডিওকৃত ছবি দেখতে চলে গেছে—এ তো অর্ধসত্য। সারা সপ্তাহ ঘরে বসে ক্ষুদ্রপর্দায় ছবি বা প্রোগ্রাম দেখা থেকে মুক্তি চায় অনেকেই। কিন্তু যাবে কোথায়? ছবিঘরের ছবির মান, সামাজিক আবহাওয়া এবং ব্যয়বাহুল্য সীমিত আয়ের রুচিশীল পারিবারিক দর্শকের জন্য নিরুৎসাহব্যঞ্জক। এই অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন আশা করা অযৌক্তিক। চলচ্চিত্রের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর ফিরবে না। বিভাগোত্তর ওপার বাংলায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমগত উৎকর্ষ উন্নতির চরমে পৌঁছাচ্ছে। এসেছেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, বুদ্ধদেব, উৎপলেন্দু বা অপর্ণার মত দীপ্তবীর্য চলচ্চিত্রস্রষ্টা। এপার বাংলায় একই স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে আমরা দৌড়েছি বিপরীত দিকে: সাহিত্য থেকে লোকসাহিত্যে, সেখান থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন শূন্যতায়।
চলচ্চিত্র এ বছর [পঁচানব্বইয়ে] পা দেবে। অর্ধশতাব্দীরও আগে থেকে এই মাধ্যম গগনচুম্বী ব্যাপ্তি ও শৈল্পিক উৎকর্ষ আহরণ করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু এ দেশে এখনো এর সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা হল না। এই বেঢপ দুরন্ত বামনটি না শিশু, না যুবক, না প্রৌঢ়। ছবিকে এখনো শিক্ষিত দর্শকও ‘বই’ বলে ভুল করে। তাহলে প্রজ্ঞাদীপ্ত জীবনভিত্তিক ছবি নির্মাণ বা শিল্পিত চলচ্চিত্র সংস্কৃতি প্রসারের কোন আশাই কি নেই?
আছে—উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত সরকারি এবং বেসরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রশিক্ষণ ও চলচ্চিত্র মাধ্যম অধ্যয়নের সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ধারার বাইরে একটি দ্বিতীয় ধারার সৃষ্টি করতে পারলে কেবল চলে যাওয়া দর্শকই ফিরে আসবে না, বিপুল কলেবরে নতুন দর্শকশ্রেণিও সৃষ্টি হবে। জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালার খসড়াতে এরকম একটি নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রধারার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সংগঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। দেশ বঙ্গোপসাগরে ভেসে না গেলে সুবাতাস একদিন নিশ্চয়ই বইবে।
দ্বিতীয় কিস্তি
বিভাগোত্তর ঢাকায় চিত্রনির্মাণ শিল্পের সূচনার পূর্বে চলচ্চিত্র দর্শকের শ্রেণি এবং রুচি-চরিত্র ছিল বিভাগপূর্ব বাংলার অনুরূপ। শিক্ষিত পারিবারিক দর্শককে আকর্ষণ করতে প্রদর্শন হলের মান এবং পরিবেশ উন্নত হওয়া প্রয়োজন। তাই লায়ন বা তাজমহল সিনেমার মত দুয়েকটি নিম্নবিত্ত উপযোগী হল বাদ দিলে ঢাকা এবং মফস্বলের অধিকাংশ হলই মধ্যবিত্তের রুচি অনুযায়ী চালান হত। কলকাতা থেকে আমদানিকৃত বাংলা ছবি তো ছিলই। উন্নতমানের ইংরেজি বা ভাষান্তরিত ধ্রুপদী ছবিও প্রদর্শন করা হত। আজ ভাবতেও অবাক লাগে যে ঢাকার মত লাখ দুই মানুষের শহরে ‘বাইসাইকেল থিবস’ (১৯৪৮), ‘বিটার রাইস’ (১৯৪৯), ‘এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ারে’র (১৯৫১) মত বিশ্বনন্দিত ছবির নিয়মিত প্রদর্শনী হত।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্র দর্শকের শ্রেণিচরিত্র এবং হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িকতার অভাব পাকিস্তানি শাসকচক্র এবং তাদের স্থানীয় ধর্মান্ধ তাঁবেদারদের চিন্তিত করে তোলে। বাঙ্গালিকে তার মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে ‘ইসলামে’র নামে উর্দু গ্রহণ করাবার একটি ষড়যন্ত্র ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনে চিরতরে নস্যাৎ হয়ে যায়। উর্দু গলাধঃকরণ করাতে পারলে লাহোরে নির্মিত ছবি দিয়ে এই উপনিবেশের চালচ্চিত্রিক তথা সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণা পাল্টে দেয়া যেত। তা হল না।
এদিকে কলকাতার বাংলা ছবির প্রভাব রহিত করার একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ততদিনে করাচিতে নেয়া হয়ে গেছে। দুহাজার মাইল উড়ে গিয়ে লাহোরের অনুকূল রাজনৈতিক আবহাওয়ার, শাসকচক্রের অবক্ষয়ী এবং গণতন্ত্রবিরোধী মানসিকতার উপযোগী বাংলা ছবি নির্মাণও অবাস্তব বলে মনে হওয়ায় ঢাকাতেই একটি ক্ষুদ্র চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল অবশ্যই ষড়যন্ত্রমূলক। সীমিত কলেবরের এই শিল্পের উদ্দেশ্য হবে বছরে গোটাকয়েক যেনতেন ধরনের বাংলা ছবি করে কলকাতার বাংলা ছবি আমদানি বন্ধ করার সুযোগ তৈরি করা। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রকরণে পূর্ণ অনভিজ্ঞতা এবং সীমিত প্রাদেশিক বাজারের কারণে এসব বাংলা ছবি কোনদিনই উর্দু ছবির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না—কেবল এ ধরনের একটা হিশেবই শাসকদের ছিল না, তাদের লক্ষ্য ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। উর্দু ছবির আবেদন ছিল ‘হান্টারওয়ালি’ কিসিমের। অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল ‘হীরামন্ডি’ সংস্কৃতিনির্ভর যৌনতা এবং ‘দমাদম মাস্ত কলন্দর’ জাতীয় ভণ্ডামি।
তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল জনপ্রিয় তারকা বিবর্জিত ঢাকাই বাংলা সামাজিক ছবি অচিরেই মার খাবে এবং যথাসময়ে জনবহুল গোটা বাজারটাই উর্দু ছবির কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। কিন্তু স্বার্থান্ধ যুক্তি স্বভাবতই একচোখা ও দূরদৃষ্টি বিবর্জিত। প্রাথমিক অবস্থায় ষড়যন্ত্রমতই ফল হল। ঢাকায় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ সূচনার পাঁচ বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় তারকা, নির্মাণকুশলতা এবং পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে কলকাতার আদলে তৈরি বাংলা ছবি প্রায় ধরাশায়ী। গোটা বাজারটাই তখন পাকিস্তানি উর্দু ছবির দখলের জন্য প্রস্তুত।
এমন সময় নিয়তি বাগড়া দিল। জনপ্রিয় যাত্রা-নাটক ‘রূপবান’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রায়িত হয়ে কেবল বাংলা ছবির বাজারই পুনর্দখল করল না, লাহোরি পরগাছা ছবিকেও ঝেঁটিয়ে বিদায় করল। অবশ্য সমকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবদানও এক্ষেত্রে অপরিসীম। ‘রূপবানে’র আবির্ভাব বাংলা ভাষার ছবির বাজার নিশ্চিত করল ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে বস্তুনিষ্ঠ বাস্তববাদী চলচ্চিত্রেরও ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দিল।
কলকাতার চলচ্চিত্র নির্মাতারা ছিলেন মহানগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক। তাঁদের কাছে নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার অস্তিত্ব ছিল মূলত কলকাতা বন্দরের রপ্তানিপণ্যের যোগানদার হিশেবে। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠের বাসভূমি হলেও এই ভূখণ্ডের মেহনতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বা স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতির কোন প্রতিফলন কলকাতার ছবিতে পাওয়া যেত কদাচিৎ।
বিভাগের পর এই জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক তথা সাংস্কৃতিক নির্ভরতা কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ক্রমান্বয়ে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন ঐতিহাসিক নিয়মেই স্বাভাবিকভাবে প্রতিফলিত হত—শিল্পমান বা কারিগরি সূক্ষ্মতা জলাঞ্জলি না দিয়েও। কিন্তু করাচির শাসকচক্রের রাতারাতি অপারেশনের ফলে এল ‘রূপবান’। উর্দু ছবি মার খেল। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশও পেল একটি বেঢপ বামন চলচ্চিত্র শিল্প।
যা হোক, বাংলা ছবির নবলব্ধ জনপ্রিয়তার এক কণা হিস্যাও কিছুটা বাস্তবতানির্ভর সামাজিক ছবির ভাগ্যে জুটল না। শুরু হল শিক্ষিত দর্শকশ্রেণির প্রস্থান এবং বিশালতর সংখ্যায় নতুন নিম্নবিত্ত দর্শকশ্রেণির আগমন, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেখতে দেখতে বাণিজ্যিক ছবির ভিত সুপ্রোথিত হল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের কালে এই ধারাটি কিছুকালের জন্য থমকে যায়। চলচ্চিত্রাঙ্গন আবার মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিল নবতরঙ্গের জন্য। কিন্তু তদানীন্তন সরকারের উপযুক্ত দিঙ্নির্ণয় প্রচেষ্টা এবং তদারকির অক্ষমতার দরুন আজকের অবক্ষয়সম্পৃক্ত বেঁটে নধরকান্তি বাণিজ্যিক দৈত্যের আবির্ভাব।
প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশক ও প্রদর্শকের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অবিচ্ছেদ্য স্বার্থবন্ধন। প্রগতিবাদী গণ-শিল্পমাধ্যম হিশেবে চলচ্চিত্রের সব সম্ভাবনাই আজ নিশ্চিহ্ন।
দুঃসাহসী কতিপয় অবশ্য আজও পুরোপুরি রণেভঙ্গ দেননি। তবে অবর্ণনীয় প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পৈতৃক জমি, স্ত্রীর গহনা বা সুহৃদদের পকেটে থাবা মেরে তাঁরা হয়ত ছবি বানাতে পারবেন, কিন্তু প্রদর্শক সেসব ছবি পারতসাধ্যে ছোঁবেন না। কখনো কখনো পরিবেশক বা প্রদর্শকের ফরমায়েশ মাফিক ছবিতে নাচ, গান, ভাঁড়ামির দৃশ্য সংযোজন করে কয়েকটি বাণিজ্যিক হলে মুক্তির ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ঐ ধরনের যুক্তি-বিযুক্তির কারণে ছবি শিল্পকর্ম তো হয়ইনি, পর্যাপ্ত বাণিজ্যও করেনি— অন্তত প্রদর্শকের মাপকাঠিতে। চলচ্চিত্র সদিচ্ছার বিরুদ্ধে এও আরেকটি ষড়যন্ত্র। ফলে অধিকাংশ ব্যতিক্রমী নির্মাতার পক্ষে আর দ্বিতীয় ছবি করা সম্ভব হয়নি। সরকারি অনুদানে কয়েকটি মোটামুটি বস্তুনিষ্ঠ ছবি হয়েছে [বটে], কিন্তু প্রদর্শক শ্রেণির চরম অবজ্ঞার কারণে এগুলো অধিকাংশই ঢাকার বাইরে মুক্তি পায়নি। তাও শান্তি নেই। স্বার্থান্ধ একটি বিশেষ মহলের চাপে সরকারি অনুদান প্রথাও বন্ধ হয়ে গেছে।
[১৯৮৯]