নিয়মিত হাঁটলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে
বর্তমানে হৃদরোগ একটি প্রচলিত সমস্যা। মানুষের বর্তমান জীবনে চাপ এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার হৃদরোগকে বাড়িয়ে তোলে। আজ ২০ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১২৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ইব্রাহিম কার্ডিয়াক ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ।
প্রশ্ন : হৃদরোগে অত্যন্ত ব্যাপক সংখ্যায় মানুষ আক্রান্ত হয় আমরা জানি। একটা সময় ছিল ৪০ বছরের বেশি হলে মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতো। কিন্তু এখন আমরা দেখছি হৃদরোগ কোনো বয়সও মানছে না। এই রোগটার ঝুঁকি যে দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে, এর কারণ কী?
উত্তর : বর্তমানে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে হৃদরোগ মহামারী আকারে দেখা দিচ্ছে। কেন হৃদরোগ এখন বেশি হচ্ছে? হৃদরোগ আসলে আগেও হয়েছে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। কারণ মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে গেছে, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। হাঁটার জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে- এগুলোও কারণ। এগুলো ছাড়াও কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ আছে যেগুলো আমাদের ভাষায় বলি মডিফায়াবল রিস্ক ফ্যাক্টর বা পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি।
আরেকটি হচ্ছে আনমোডিফায়াবল রিস্ক ফ্যাক্টর। আনমডিফায়াবল রিস্ক ফ্যাক্টর বলতে বোঝায় পরিবর্তনযোগ্য নয়। যেমন : বয়স, পারিবারিক ইতিহাস- এগুলো পরিবর্তনযোগ্য নয়। এ দুটো বাদে অন্য যেসব ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রয়েছে, যেটা পরিবর্তনশীল। যেমন, কেউ যদি ধূমপান করে, সে ধূমপান পরিবর্তন করতে পারে। ধূমপান অন্যতম একটি ঝুঁকির কারণ। ডায়াবেটিস একটি ঝুঁকির কারণ। রক্তে যদি কোলেস্টেরল বেশি থাকে, সেটাও একটা ঝুঁকির কারণ। উচ্চ রক্তচাপ আরেকটি ঝুঁকির কারণ। এবং বর্তমানে এই সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভেতরে মানুষের অনেক ধরনের মানসিক চাপ থাকে। সেটা পারিবারিক হোক, সামাজিক হোক বা তার কর্মক্ষেত্রে হোক। এগুলো সবই এক একটা ঝুঁকি, যেগুলো হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রশ্ন : আগে আমরা জানতাম বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। তবে এখন দেখা যায় অনেক কম বয়সেই এই রোগের ঝুঁকি থাকে। এর কারণ কী?
উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন। এখন অনেক অল্প বয়স থেকেই মানুষ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এখন কাজের ক্ষেত্রে বা সামাজিকভাবে মানসিক চাপগুলো অনেক বেশি। পাশাপাশি তার ছোটবেলা থেকে যে খাদ্যাভ্যাস সেটাও এর কারণ। যেমন : বিভিন্ন জাংকফুড খাই, নিজেরা পরিশ্রম করি না, হাঁটাচলা করি না -এসব কারণে এই সমস্যা হয়। খাবারের ভেতরে আঁশজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া উচিত। শাকসবজি বেশি খাওয়া উচিত। কিন্তু এগুলো না খেয়ে আমরা ফাস্টফুডের দিকে বেশি যাই। আমরা ভারী খাবারের দিকে বেশি যাই। এগুলো খাওয়ার জন্য দেখা যাচ্ছে তার পরিপূর্ণ বয়সের আগেই অর্থাৎ ৪০ বছরের আগেই হৃদরোগ হয়। কখনো ২০-২২ বছর বয়সেও করোনারি আর্টারি রোগ হচ্ছে, হার্টের রোগ হচ্ছে।
প্রশ্ন : তাহলে এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
উত্তর : আমরা এই রোগকে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করতে পারি। এটা একটা ভালো সংবাদ। আরেকটি বিষয় রয়েছে যেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমি রিং লাগাই, স্ট্যান্টিং করি বা ওষুধ খাই না কেন সবকিছুই ব্যয়সাপেক্ষ। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় এটি অত্যন্ত একটি ব্যয়বহুল ব্যাধি। তবে সবকিছু পরিবর্তন করে এটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা যদি ধূমপানকে পরিত্যাগ করি। ডায়াবেটিস হলে নিয়ন্ত্রণে রাখব। আর ডায়াবেটিস যেন না হয় সে জন্য যদি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করি। নিয়মিত হাঁটাচলা করি, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করি, মিষ্টিজাতীয় জিনিস বা চর্বিজাতীয় জিনিস কম খাই, কার্বোহাইড্রেট কম খাই তাহলে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। উচ্চরক্তচাপও প্রতিরোধ করা সম্ভব। কোলেস্টেরলও পরিবর্তন করা সম্ভব। পাশাপাশি যদি জীবনযাপনে শৃঙ্খলা আনতে পারি, তবে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং চিকিৎসার দিকে না গিয়ে আমাদের প্রতিরোধের দিকেই যাওয়া উচিত।
প্রশ্ন : একজন মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তনের মধ্যে একটা হচ্ছে খাবারদাবার। আরেকটি হচ্ছে তার হাঁটাচলা, ব্যায়াম। একজন মানুষের দেহকে সুস্থ রাখার জন্য কত সময় নিয়ে হাঁটা উচিত? আবার সময় নিয়েও সংশয় আছে বিকেলে হাঁটব, সকালে হাঁটব না কি সন্ধ্যায় হাঁটব। আপনার কী মত?
উত্তর : আসলে আপনি ঠিকই বলেছেন, আসলে আপনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার সুবিধামতো যেকোনো সময়ে হাঁটতে পারেন। তবে পরিমাণটা কতটুকু? যদি প্রতিদিন হাঁটেন কমপক্ষে ৩০ মিনিট। বেশি হাঁটতে পারলে ক্ষতি নেই। আর যদি সপ্তাহে তিনদিন হাঁটেন তবে এক ঘণ্টা করে হাঁটতে হবে। এবং সেই হাঁটার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বের করে নিতে হবে। রিলাক্সভাবে হাঁটতে হবে। হাঁটার সময় যেন মানসিক চাপ কাজ না করে।
প্রশ্ন: হাঁটার গতি নিয়ে প্রশ্ন আসে। অনেকে খুব ধীরেসুস্থে হাঁটেন, আবার অনেকে মনে করেন আমার এমনভাবে হাঁটতে হবে যেন শরীর থেকে ঘাম ঝরে। আপনার মত কী?
উত্তর : এটাও আপনি ঠিক বলেছেন। তবে একটা জিনিস কি, গাড়ি যখন চালাই তখন প্রথমেই কি চার নম্বর গিয়ারে যাই। এক থেকে শুরু করি। হাঁটাও অনেকটা এই রকম। প্রথম দিকে আপনাকে শরীরটাকে ওয়ার্মআপ করতে হবে।
আস্তে আস্তে গতি বাড়াবেন। প্রথম ৩০ মিনিটকে তিনভাগে ভাগ করে ফেলেন। প্রথমে আপনার হবে ওয়ার্মআপ। মধ্যম ১০ মিনিট আপনকে গতি বাড়াতে হবে। পরবর্তী ১০ মিনিটে আপনি গতি কমিয়ে ফেললেন এবং থেমে গেলেন।
তাহলে এভাবে যদি আপনি করেন তবে ক্লান্ত হবেন না। আপনি যদি প্রথমেই দৌড় দেন তবে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। সে জন্য হাঁটার ভেতরও একটা নিয়ম আছে এবং সে নিয়ম মেনে হাঁটা উচিত। এটা আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : বিভিন্ন রকম সয়াবিন তেলের গায়ে দেখতে পাই এটা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে সম্প্রতি মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিবেদন বলা হয়েছে, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, তেলের মধ্যে ৭৮ শতাংশ ভেজাল রয়েছে। এখন এই ভেজাল সয়াবিন তেল এবং তেল বেশি খাওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় কি না?
উত্তর : মূলত সয়াবিন তেল তো ভেজিটেবল অয়েল। ভেজিটেবল অয়েলে তা কিছু না কিছু কোলেস্টেরল বা চর্বি থাকে। মানুষের শরীরেও কিছু চর্বির প্রয়োজন আছে। তবে অতিরিক্ত হলে সেটা ক্ষতিকর হতে পারে। রক্তনালির ভেতর চর্বি জমে হৃদরোগের কারণ হতে পারে। সেটাকে বন্ধ করে ফেলে একসময়, নদীতে চর পড়ার মতো। তবে এই জিনিসগুলো যে একদিনে হয় বিষয়টি তা নয়। আস্তে আস্তে, দীর্ঘদিন ধরে হয়। যদি তেলে ভেজাল থাকে এবং কোলেস্টেরল বেশি থাকে, তবে অবশ্যই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াবে। রক্তনালিতে এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই হবে। ভেজালের প্রভাব আসলে সারা শরীরেই পড়ে।
ট্যাগ : হৃদরোগ