বুকে ব্যথা কেন হয়?
বুকের ব্যথা বিভিন্ন কারণে হয়। সব বুকের ব্যথাতেই ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে কিছু কিছু লক্ষণ দেখলে বুকের ব্যথাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আজ ৬ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৪৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ।
প্রশ্ন : বুকে ব্যথা হলে আমরা বেশির ভাগ সময় আতঙ্কিত হয়ে যাই। কারণ হচ্ছে আমাদের বুকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাকে। আমরা প্রথমে ভয় পাই, হার্টে কোনো সমস্যা হলো কি না। আসলে প্রচলিত কী কী কারণে বুকে ব্যথা হয়?
উত্তর : বুকে ব্যথা নিয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, বুকের ভেতরে চামড়া থেকে শুরু করে যতগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে- হাড়, পেশি, ফুসফুস, ফুসফুসের পর্দা, হার্টের পর্দা, ভেতরে অংশ আছে, বাইরের অংশ- প্রত্যেকটির কারণেই বুকে ব্যথা হতে পারে। নিউরোলজিক্যাল কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে। আবার কোনো কারণ ছাড়াই বুকে ব্যথা হতে পারে। আবার ঘাড়ের থেকে ব্যথা হতে পারে, হাতের থেকে ব্যথা হতে পারে। গ্যাসট্রিকের সমস্যা হতে পারে। আবার পেটে এসিডিটি হলে সেখানেও অনেক সময় চাপের কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে। তবে বিষয়টার গুরুত্ব নির্ভর করে কোন ব্যথার ধরন কেমন হবে তার ওপর। একটা মধ্যবয়সী মানুষ বা ৩০ বছরের ওপরে একটা লোক যদি ধূমপান করে, তার পারিবারিক ইতিহাসে যদি হৃদরোগের প্রকোপ থাকে, তার যদি ওজন বেশি হয়, তার যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, এই সমস্ত লোকের যদি বুকের মধ্যখানে ডানদিকে বা বাম দিকে ব্যথা হয়, হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয় অর্থাৎ পরিশ্রম করলে সে যদি কোনো অস্বস্তিবোধ করে, চাপ বোধ করে আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায় তবে গুরুত্ব দিতে হবে।urgentPhoto
এই ব্যথা যদি বাম হাতে পুরো জায়গায়, আঙুল পর্যন্ত চলে আসে, গলায় চলে আসে, দাঁতের গোড়া পর্যন্ত চলে যায় তাহলে একে গুরুত্ব দিতে হবে। অনেকে এরকম অসুবিধা নিয়ে দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যায়, নাক কান গলা বিভাগের চিকিৎসকের কাছে যায়, আসলে সে কারণে সমস্যাটি হয় না। এই অবস্থাটিকে আমরা বলি স্ট্যাবল এনজাইনা প্যাকটোরিস অথবা এফোর্ট এনজাইনা। আসলে এর উৎসটা হার্ট, তবে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে অন্য জায়গায়ও। যদি কাজের সঙ্গে ব্যথাটার সম্পৃক্ত থাকে তবে অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ।
এই ব্যথা সাধারণত স্থায়ী হয় পাঁচ থেকে ১০ মিনিট। বিশ্রাম নিলে কমে যায়। অথবা কেউ যদি নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে নেয়, এতে যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে কমে যায়, তাহলে এই ব্যথাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর যদি দেখা যায় ব্যথাটা আসছে, আবার চলে যাচ্ছে এটার কোনো গুরুত্ব নেই। এটাকে এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে যেসব ঝুঁকির কারণগুলো বললাম, মধ্যবয়সী ৩০ বছরের বেশি বয়সের লোক, তার যদি ডায়াবেটিস থাকে, সে যদি ধূমপান করে, তার যদি শরীরের ওজন বেশি থাকে, হাঁটাচলা করে না, চাপযুক্ত চাকরি করে এ রকম লোকদের যদি এসব অসুবিধা হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন : যেকোনো ব্যথা হলেই, কষ্ট হলেই তার চিকিৎসকের কাছে রোগ নির্ণয়ের জন্য যাওয়া উচিত, রোগ নির্ণয় করা উচিত। তবে আপনি যে ধরনটা বললেন, সেটা হলে ধরে নিতে হবে এটা হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং গুরুত্ব নিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : নিজে নিজে রোগ নির্ণয় না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। অনেকেই বলে আমার গ্যাসট্রিক হয়েছে। গ্যাসট্রিকের ওষুধ খায়, অপেক্ষা করে। হার্ট অ্যাটাক হলেও অনেকে বলে মনে হয় গ্যাসট্রিকের সমস্যা হচ্ছে, ঢেঁকুর দিলে আরাম পাচ্ছি। কিন্তু ভেতরে দেখা যায় হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : রোগী যদি হঠাৎ বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে এবং তার আগে হৃদরোগের ইতিহাস আছে, সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে তাৎক্ষণিকভাবে কী কিছু করণীয় আছে?
উত্তর : অবশ্যই করণীয় আছে। কারণ হাসপাতালে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তো একটু ঠিক হতে হবে। এ রকম অসুবিধা হলে অবশ্যই তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। এবং তার যদি বাড়িতে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে বা ট্যাবলেট থাকে এবং আগে থেকে বিষয়টি জানা থাকে, তাহলে সে একটু বসে বা শুয়ে স্প্রে করতে পারে। তবে ওই সময়ের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব, কার্ডিয়াক সুবিধা রয়েছে এ রকম একটা জরুরি বিভাগে যাওয়া অবশ্যই জরুরি।
প্রশ্ন : এ সময় অ্যান্টিকগুলেন্ট বা অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার কোনো উপকারিতা আছে কী?
উত্তর : যদি সে বুঝতে পারে, তার হার্টেরই সমস্যা হচ্ছে, বা ব্যথা যদি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, প্রচণ্ড রকম ব্যথা হয়, তাহলে ৩০০ মিলিগ্রামের অ্যাসপিরিন চারটি একসঙ্গে খেয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ ৩০০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট চারটা একসঙ্গে খাবে, খেয়ে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যাবে।
অ্যাসপিরিনের সঙ্গে ক্লোপিডোগ্রিল-জাতীয় ওষুধ আছে, এটা ৭৫ মিলিগ্রামে পাওয়া যায়, ছয়টা বড়ি একবারে খেয়ে নিতে পারে। তবে যদি সমস্যা বেশি হয় তাহলে খাবে। খেলে ক্ষতি হবে না কোনো। খেলে যে বিরাট কোনো সমস্যা হয়ে যাবে, মরে যাবে, ক্ষতি হবে সেটা নয়। বরং উপকার হবে।
প্রশ্ন : হৃদরোগে, বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকের বেলায় সময়টা অত্যন্ত মূল্যবান আপনারা বলে থাকেন। যতদ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। একজন রোগী হার্ট অ্যাটাক হলে কত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে ক্ষতি তুলনামূলক কম হবে?
উত্তর : বর্তমানে চিকিৎসার ধরন পাল্টে গেছে। বুকে ব্যথার শুরুর থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে যদি একটা লোক জরুরি বিভাগে কার্ডিয়াক ইনস্টিটিউটে পৌঁছাতে পারে তখন ভালো হয়। কারণ এটি হলো স্বর্ণ সময়। কারণ এই সময়ের মধ্যে হার্টের পেশিগুলো নষ্ট হয় না। তখন একটা জটিল পর্যায় চলে, হার্ট অ্যাটাকের আগে এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। যাকে আমরা প্যাথোফিজিক্যালই যদি চিন্তা করি তাহলে প্রথমে বন্ধ হয়ে ক্লটের মতো তৈরি করে। একটা প্লাক রাপসার হয়। রক্তক্ষরণ হয়ে পুরো পথকে বন্ধ করে ফেলে। এ রকম অবস্থার মধ্যে সে যদি হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে, তাহলে ভালো হয়। আজকাল অধিকাংশ হাসপাতালে প্রাইমারি পিসিআই বলে একটা জিনিস আছে, জরুরি বিভগে রোগী গেলে দ্রুত ক্যাথল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ক্যাথল্যাবে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এনজিওগ্রাম করে তার যদি কোনো ব্লক পাওয়া যায়, তাহলে এটাকে খুলে দেওয়া যায়। করলে পেশি আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
প্রশ্ন : যদি আরো দেরি হয়?
উত্তর : আরো দেরি হলে এর মধ্যে তার হার্টের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন অন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসার বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। ধাপে ধাপে আমরা চিকিৎসা দিই। আন্তর্জাতিকভাবে গাইডলাইন আছে সেগুলো অনুসরণ করে চিকিৎসা করা হয়। কী ধরনের চিকিৎসা করতে হবে সেই গাইডলাইন অনুসারে আমরা কাজ করি।
প্রশ্ন : আমরা জানি, এখন বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসা খুব উন্নত। এখন আমাদের কোনো রোগীর সাধারণত বিদেশে যাওয়ার আর প্রয়োজন হয় না। সব চিকিৎসা বাংলাদেশে হয়। সাধারণত আপনারা কী ধরনের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : হৃদরোগে চিকিৎসা করতে আগে সমস্যাটা নির্ণয় করতে হবে। সেটা নির্ণয় করতে গেলে শেষ পর্যন্ত একটা এনজিওগ্রাম করে রোগটির অবস্থা বুঝে চিকিৎসা করতে হবে। কিছু সমস্যায় ওষুধপত্র, জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে চিকিৎসা করা সম্ভব। এগুলো ঠিক করে সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আরেকটি হলো এনজিওপ্লাস্টি, রক্তনালি যেখানে ব্লক পাওয়া যায়, এটাকে বেলুন দিয়ে খুলে এর ভেতরে একটা স্ট্যানটিং বসিয়ে দেওয়া হয়। যাতে আবার বন্ধ না হয়ে যায়।
আরেকটি রয়েছে, ওপেন হার্ট সার্জারি। তবে এটা করার হার আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে। বেশি হলে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারি লাগে। বাদবাকি সবগুলো এনজিওপ্লাস্টি বা তার মাধ্যমে করা হয়।