মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে কী করবেন
ওরাল ক্যানসার বা মুখের ক্যানসারে বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক লোক আক্রান্ত হচ্ছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বলা যায়, বিশ্বের উন্নত দেশে যে পরিমাণ মুখের ক্যানসার হয়, এর তুলনায় বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে এই রোগে বেশি লোক আক্রান্ত হচ্ছে।
আজ ৪ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহমুদা আক্তার।
প্রশ্ন : এ দেশে মুখের ক্যানসার এত বেশি হওয়ার কারণ কী?
উত্তর : মুখের ক্যানসারের মূল কারণ হলো পান, চুন, সুপারি—যেগুলোকে আমরা সাধারণত ধোঁয়াহীন তামাক হিসেবে চিহ্নিত করি, সেগুলোই আসলে প্রধান কারণ। এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে, যেমন : ভাঙা দাঁত, আবার হয়তো অনেক দিন ধরে ব্যক্তি মুখগহ্বরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলছে না, এগুলোর কারণেও সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : ক্যানসারের জন্য সাধারণত ধূমপানকে দায়ী করা হয় এবং এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার আছে, মানুষ যথেষ্ট সচেতন। আপনি বলবেন কি ধোঁয়াহীন তামাক বা চিবিয়ে খাওয়ার তামাকজাত দ্রব্য, যেমন : জর্দা, সাদাপাতা, খৈনি, গুল—এগুলোর প্রভাব মুখের ক্যানসার বা গলার ক্যানসারের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর : ধোঁয়াহীন তামাকই মূলত এই এলাকার মুখের ক্যানসারের জন্য দায়ী। যেটা আপনি বলছিলেন পান, গুল, সাদাপাতা, জর্দা, খয়ের এই জিনিসগুলো আমাদের দেশে মানুষ বেশি ব্যবহার করে এবং গালের মধ্যে রেখে দেয়। ফলে নিয়মিত রাখার জন্য সেগুলো থেকে শেষ পর্যন্ত একটা পরিবর্তন চলে আসে। আমাদের মুখের চামড়া অনেক পাতলা। সেটা রাফ হয়ে অনেক পরিবর্তন চলে আসে।
প্রশ্ন : ক্যানসার হলে মুখের ঘা কেমন হয়?
উত্তর : মুখে ঘা হলেই ক্যানসার নয়। যেকোনো একটি ঘা সাধারণত যদি দুই সপ্তাহের বেশি থাকে, ঘায়ে কোনো ব্যথা নেই, রোগীর কোনো অভিযোগ নেই, কেবল একটি ঘা ধীরে ধীরে এটা বড় হয়ে যাচ্ছে। শক্ত হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা। এ ধরনের লক্ষণ থাকলে ঘা থেকে ক্যানসার হতে পারে বলে ধরে নিই।
প্রশ্ন : রোগটি ক্যানসার কি না, এটা নির্দিষ্ট করার জন্য আপনারা কী করেন?
উত্তর : নির্ণয় করার জন্য প্রথমে রোগীর একটি ইতিহাস নেই। তার ধোঁয়াহীন তামাক খাওয়ার অভ্যাস আছে কি না। এর পর এটাকে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওখান থেকে মাংস নিয়ে পরীক্ষা করতে পাঠাই। সেই পরীক্ষা এলে ধরা পড়ে এটা ক্যানসার কি না।
প্রশ্ন : মুখের ক্যানসারের চিকিৎসায় সফলতার হার কেমন এবং কী করার আছে?
উত্তর : আগে তো যক্ষ্মা নিয়েও মানুষের মনে আতঙ্ক কাজ করত যে এটা হলে আর বাঁচবে না। ঠিক ক্যানসার হলে বাঁচবে না, এমন একটা আতঙ্ক মানুষের মধ্যে ছিল। তবে এখন আর কথাটা ঠিক না। এখন ক্যানসারের অনেক উন্নত চিকিৎসা চলে আসছে, বিশেষ করে মুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে। অনেকভাবে চিকিৎসা করা যেতে পারে। আমরা অস্ত্রোপচার করতে পারি। রেডিওথেরাপি দেওয়া যেতে পারে অথবা কেমোথেরাপি দেওয়া যায়। মুখের ক্যানসারে এখন রোগীর চিকিৎসা করলে সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
প্রশ্ন : ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক পর্যায় আছে। আপনি বলবেন কি কোন পর্যায়ে গেলে আপনারা রোগীকে কী চিকিৎসা দেন এবং কোন ধরনের রোগী ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
উত্তর : সব ধরনের ক্যানসারকে আমরা গ্রেডিং করি, এটা কত বেশি খারাপ। প্রথম হচ্ছে ক্যানসারটা কত বেশি খারাপ, দুই হচ্ছে কত বেশি শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা গ্রেডিং বা পর্যায় নির্ণয় করি। সাধারণত ক্যানসারের রোগী আমাদের কাছে যত আগে আসবে, ততই এটা ভালো হয়। যেমন রোগী হয়তো একটা ছোট ঘা নিয়ে আমাদের কাছে এলো, এটা হয়তো গলার দিকে কিছুটা ছড়িয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি কেবল অস্ত্রোপচারও করে দিই, রোগীর সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ছোট থাকলে কেবল অস্ত্রোপচার করেই রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারি। এ ছাড়া রেডিওথেরাপি দিয়েও অনেক সময় চিকিৎসা করা হয়। বিশেষ করে গলার দিকে যেটা থাকে, সে ধরনের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি করা হয়। আসলে মুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারই বেশি কার্যকর হয়।
প্রশ্ন : যদি প্রাথমিক অবস্থায় রোগী না আসে, ক্যানসার যদি বেড়ে যায় তখন সার্জারির সঙ্গে আর কী প্রয়োজন পড়ে?
উত্তর : বড় হলে রোগীর মন খারাপের কোনো কারণ নেই যে আমি বাঁচব না। বা আমার এটা ভালো হবে না। তখনো রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। আসলে তখন সার্জারিটা একটু বড় হয়, যতখানি ছড়িয়েছে সেই পর্যন্ত আমাদের যেতে হয়। এরপর আমরা হয়তো রোগীকে রেডিওথেরাপিতে পাঠাতে পারি। কেমোথেরাপিতে পাঠাতে পারি। অথবা দুটোই একসঙ্গে করতে পারি। অসুখটা কতখানি ছড়িয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে অস্ত্রোপচারের পর রেডিওথেরাপি করতে পারি। অথবা কেমোথেরাপি করতে পারি। অথবা দুটোর জন্যই রোগীকে আমরা পাঠাতে পারি।
প্রশ্ন : অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির পরে মুখমণ্ডলের আকৃতি ঠিক থাকবে কি না, এ রকম একটা প্রশ্ন আসে। অনেক ক্ষেত্রে চোয়াল ফেলে দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে আপনারা কী করেন?
উত্তর : আমরা যাঁরা ক্যানসারের সার্জারি করি, আমাদের একটা বাড়তি চিন্তা করতে হয়, কেটে হয়তো ফেলে দিলাম, কিন্তু জোড়াটা লাগাব কী করে? আসলে প্রত্যেক রোগীই চায়, আমাকে দেখতে যেন খুব অদ্ভুত না লাগে। তাই সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করে যদি চোয়াল ফেলে দিই, তখন কৃত্রিম কিছু বিষয় থাকে পুনরায় সেটাকে দিয়ে ঠিক করে দিতে পারি। অথবা গালের কিছু অংশ হয়তো ফেলে দিলাম, সে ক্ষেত্রে শরীরে অন্য জায়গা থেকে মাংস এনে পুনর্গঠন করে দিতে পারি, যাতে করে তার চেহারাকে বিকৃত না লাগে। এই পুনর্গঠনের চিন্তা মাথায় রেখে আমাদের অস্ত্রোপচার করতে হয়।
প্রশ্ন : মুখের ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : যেহেতু এর মূল কারণ হচ্ছে ধোঁয়াবিহীন তামাক, পান, চুন, সাদাপাতা, খয়ের, গুল—এগুলোকে যদি আমরা একটু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারি। আরেকটি বিষয় হলো, মানুষের দেহের পুষ্টির অভাবও ক্যানসার হওয়ার একটি কারণ। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন। তাই সেটিও একটি কারণ। এ ছাড়া যদি আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারি যে মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উন্নতি করা উচিত। ভাঙা দাঁত থাকুক বা মুখের ক্ষয় থাকুক, সেটার চিকিৎসা করা উচিত। এই পদক্ষেপগুলো মেনে চললে আমাদের দেশে এই রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষ করে আমরা যদি ধোঁয়াহীন তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে আনতে পারি, তাতেই অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।