ফ্যাটি লিভার কেন হয়?
ফ্যাটি লিভার বা চর্বিযুক্ত লিভার বর্তমানে একটি প্রচলিত সমস্যা। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগ জটিল হয়ে লিভার সিরোসিসের মতো জটিলতা হতে পারে। আজ ৬ নভেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৯৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. ফাওয়াজর হোসাইন শুভ।
urgentPhoto
প্রশ্ন : ফ্যাটি লিভার নামের মধ্যেই একটি চর্বি চর্বি বিষয় রয়েছে। এবং বোঝা যাচ্ছে এটি লিভারের মধ্যে হচ্ছে। বিষয়টি কি তাই?
উত্তর : অনেকটা তাই। আসলে বিষয়টি হচ্ছে, লিভারের মধ্যে সাধারণত ৫ শতাংশ চর্বি শোষণ হতে পারে। যদি ৫ শতাংশের ওপরে চর্বি জমা হয়ে থাকে, তখনই আমরা একে ফ্যাটি লিভার বলে থাকি। মানে লিভারটা একটু চর্বিযুক্ত হয়ে গেছে। এই ফ্যাটি লিভারের কিছু ভাগ আমাদের কাছে আছে। এই ফ্যাটি লিভার যদি স্বাভাবিক থেকে থাকে, অর্থাৎ লিভার অ্যানজাইমগুলো যদি না বেরিয়ে থাকে, লিভারে যদি কোনো প্রদাহ না হয়ে থাকে, সেটাকে আমরা স্বাভাবিক ফ্যাটি লিভার বলি। তবে যদি এই ফ্যাটি লিভার থেকে লিভারে প্রদাহ হয়ে থাকে, তখন আমরা তাকে বলি স্ট্যাটো হেপাটাইটিস। অর্থাৎ ফ্যাটি লিভারের কারণে তার প্রদাহ হয়েছে।
উন্নত বিশ্বে এবং আমাদের দেশে অ্যালকোহল একটি বড় কারণ ফ্যাটি লিভার রোগের। আমাদের দেশে ইদানীং কিছু উচ্চবিত্ত সমাজে এই জিনিসটি একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন : আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় অনুশাসন—সব মিলিয়ে অ্যালকোহলের প্রচলন কম। আর কী কারণ আছে ফ্যাটি লিভারের?
উত্তর : অ্যালকোহল ছাড়াও থাইরয়েড হরমোনে যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে এ সমস্যা হতে পারে। কারো যদি ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে এই সমস্যা হতে পারে। যদি ব্যক্তি খুব বেশি ওজনের হয়ে থাকে, যদি মুটিয়ে যায় তখনো হতে পারে। এ ছাড়া চর্বিযুক্ত খাবার যদি বেশি খেয়ে থাকে, তাহলে সমস্যা হতে পারে। জীবনযাপনের ধরন এবং খাবারদাবার একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে। ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে যদি লিভার অ্যানজাইমগুলো বেড়ে যায়, প্রদাহ হয়, তখন যদি হেপাটাইটিস হয় পরবর্তীকালে খারাপ হতে পারে।
প্রশ্ন : কী খারাপ হতে পারে?
উত্তর : আগে ফ্যাটি লিভারকে মানুষ খুব হালকা চোখে দেখত। তবে নতুন যে ধারণাগুলো হচ্ছে, আমরা দেখছি আস্তে আস্তে লিভারে প্রদাহ হয়ে ফাইব্রোসিস হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ লিভারে যে হেপাটোসাইট, সেগুলোর মধ্যে একটা ফাইব্রোসিস হয়ে যাচ্ছে, একটা ক্ষত ভাব হয়ে পরিবর্তন আসছে। এতে এটি স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে পারছে না। এই ফাইব্রোসিস যদি হয়ে থাকে, তখন লিভার ছাড়া আরো অন্যান্য অঙ্গে কিছু পরিবর্তন আসছে। আমাদের কাছে এখন অনেক রোগী আসছে সিরোটিক লিভার নিয়ে। এটি লিভার সিরোসিসের একটি লক্ষণ হতে পারে।
প্লিহা বড় হতে পারে। অথবা পেটে পানি আসতে পারে। দেখা যাচ্ছে, রোগীর কোনো ভাইরাল মার্কার পজিটিভ নেই। হয়তো তার অ্যালকোহল খাওয়ারও কোনো ইতিহাস নেই। তখন রোগী জিজ্ঞেস করছে, তাহলে সমস্যাটি কেন হচ্ছে। আমরা তখন ইতিহাস দেখে বলি, ফ্যাটি লিভার থেকে ক্রমান্বয়ে এই পরিবর্তনগুলো আসছে।
প্রশ্ন : তার মানে হলো, ফ্যাটি লিভারকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ না করি, এই ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। ফ্যাটি লিভার যদি কারো হয়, তখন কি এটি কমানোর কোনো পদ্ধতি আছে?
উত্তর : প্রথমে আমরা দেখতে চাই, এই ফ্যাটি লিভার থেকে লিভারটা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লিভারের স্ক্যান করে দেখি। লিভারের অ্যানজাইমগুলোর অবস্থানে কোনো প্রদাহ আছে কি না, সেটি দেখি। এর পর আমরা এর কারণ দেখতে চাই। রোগীর ডায়াবেটিস রয়েছে কি না কিংবা হাইপোথাইরয়েডিজম বা অন্য কোনো কিছু আছে কি না। আর সবচেয়ে বেশি যেটি দেখতে চাই, তার জীবনযাপনের ধরন কী রকম ছিল।
প্রতিটি জিনিস নিয়ে কাজ করি তখন। যদি তার লিভারের অ্যানজাইমগুলো বেশি বেড়ে গিয়ে থাকে, এগুলো কমানোর জন্য ওষুধ দিয়ে থাকি। কারণ, শেষ পর্যায়ে এই ফ্যাটি লিভার থেকে স্ট্যাটো হেপাটাইটিস হয়ে লিভার সিরোসিস হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। এটি খুব ভীতিপ্রদ একটি বিষয়। সে জন্য আমরা প্রথমে অ্যানজাইমগুলো কমানোর জন্য ওষুধ দিয়ে থাকি।
এ ছাড়া এর পেছনে আর যে কারণগুলো রয়েছে, সেগুলোর চিকিৎসা করতে বলি। ডায়াবেটিস যদি থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে যেতে বলি। যদি থাইরয়েড হরমোনের কোনো সমস্যা থাকে, এর চিকিৎসা করতে বলি। আর যদি রোগীর বাড়তি ওজনের সমস্যা থাকে, সে ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে রাতের বেলা গরুর মাংস, খাসির মাংস, ডিমের কুসুম—এ খাবারগুলো এড়িয়ে যেতে বলি।
রাতের বেলা ভাত খাওয়া এড়িয়ে যেতে বলি। দৈনিক এক থেকে দুই ঘণ্টা আমরা হাঁটতে বলি। সঠিক খাদ্যতালিকা করে এবং পরামর্শ দিয়ে আমরা চাই তার লিভারকে ভালো রাখতে। আমি আবারো বলছি, ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিসের প্রচুর রোগী আমরা পাচ্ছি। আগে এই রোগীগুলো বেশি আমাদের কাছে আসত না।
এখন সচেতনতা অনেক বেড়ে গেছে। রোগীরা ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখলেই চলে আসে। এবং আসলেই আসা উচিত। কারণ, ফ্যাটি লিভার থেকে সিরোসিসের মাত্রা বেড়ে গেছে। সুতরাং প্রথমে যদি আমরা এর চিকিৎসা দিতে পারি, পরামর্শ দিয়ে পারি যে কারণে ফ্যাটি লিভার হচ্ছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রোগটি অনেক নিরাময়যোগ্য।
প্রশ্ন : আপনি বারবার বলছিলেন ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস হতে পারে। আপনি বলবেন কি লিভার সিরোসিস কী এবং রোগটি এত ভয়াবহ কেন?
উত্তর : লিভার সিরোসিসের সহজ বাংলা হলো লিভারের মধ্যে ক্ষত তৈরি হয়ে ফাইব্রোসিস হয়ে গেছে। অর্থাৎ লিভার কুঁচকে গেছে। লিভার যখন কুঁচকে যায়, এর থেকে কিছু পরিবর্তন আসে, যেমন—প্লিহা বড় হতে পারে। প্লিহা বড় হয়ে থাকলে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া হয়ে থাকে। এবং একই সঙ্গে খাদ্যনালির মধ্যে যে রক্তনালিগুলো আছে, সেগুলো বড় হয়ে যায়। যেকোনো সময় এগুলো ফেটে গিয়ে রোগী রক্তবমি করে আমাদের কাছে আসতে পারে। এটি খুব ভয়ানক জিনিস। এই সিরোসিসের একটি পর্যায়ে গিয়ে পেটে পানি চলে আসতে পারে। অনেক রোগী এ সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। সে ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই বলি ফ্যাটি লিভার থাকলে অবশ্যই আপনাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : সিরোসিসের চিকিৎসাব্যবস্থা কী? যদি সিরোসিসের জটিলতা শুরু হয় এটি নিরাময়যোগ্য কি না?
উত্তর : সিরোসিস যদি হয়ে থাকে, আমরা দুটো জিনিস দেখি। এটি কমপোনসেটেড অবস্থায় আছে, নাকি ডিকমপোনসেটেড অবস্থায় আছে। অর্থাৎ জন্ডিস দেখা দিয়েছে কি না। অ্যালবুমিন কম কি না। পেটে পানি আসছে কি না। কোনো প্লিহা অথবা খাদ্যনালির ভেতর রক্তনালিগুলো বড় হয়েছে কি না। এগুলো হলো কমপোনসেটিভ লক্ষণ। সিরোসিস হয়ে গেলেও একে সঠিক ব্যবস্থাপনা করা গেলে কিছুটা ভালো থাকা যাবে।
তবে যদি ডিকমপোনসেটেড হয়ে থাকে, এই লক্ষণগুলো যদি দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা করতে হবে। একদিকে যে জটিলতাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোর চিকিৎসা করতে হবে। আর পেছনে যদি তার ডায়াবেটিস বা অন্যান্য সমস্যা থাকে, তারও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। যদি বারবার সমস্যা হতে থাকে, তখন লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন শেষ ব্যবস্থা।