পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞায় কি রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস হবে
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রান্ত হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলে তাকে দুর্বল করার কৌশল গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইতিহাসের কঠিনতম অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। রাশিয়া ও পুতিনসহ পুতিনের সহযোগীদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব ব্যাংকের সাথে লেনদেন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সুইফট সিস্টেম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার বাণিজ্য জাহাজগুলোর চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর আকাশসীমায় রাশিয়ার বিমান চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গুগলসহ বিভিন্ন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম ও সার্চ ইঞ্জিন থেকেও রাশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পুতিনের ব্ল্যাকবেল্ট ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দ ও জুডো ফেডারেশন থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি ফিফা, উয়েফাসহ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকেও রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এক কথায় রাশিয়া ও পুতিনকে বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য কি রাশিয়ার পর আরোপিত এসব নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর করতে পারবে? এভাবে কি রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হবে? পুতিন নিশ্চয়ই সর্বাত্মক হামলা শুরু করার পূর্বেই এই বিষয়গুলোর হিসাব-নিকাশ করেছিলেন। কী সেই হিসাব-নিকাশ, যা পুতিনকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে?
২০১৪ সালে পুতিন যখন ক্রিমিয়ায় অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করে নেন, তখন প্রথম দফায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন। এ থেকে তিনি একটি শিক্ষা গ্রহণ করেন আর তা হলো, ডলারের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে হবে। তখন থেকে তিনি ভাবতে থাকেন, কী করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে স্বাবলম্বী রাখা যায়? এর পর সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে রাশিয়া তার অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করে। এরই অংশ হিসেবে রাশিয়া বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পাশ্চাত্য বর্হিভূত রাষ্ট্রগুলোর সাথে নতুন নতুন ও বিকল্প বাণিজ্য-সম্পর্ক স্থাপন করে। বাজেটের আকার কমিয়ে ধারাবাহিক ও নির্ভরযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনের ওপর জোর দেয়। এর ফলে গত প্রায় এক দশকে রাশিয়া প্রতিবছর এক শতাংশের কম মাত্রায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও তার অর্থনীতি হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী। এ বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী রাশিয়ার বৈদেশিক লেনদেনের মাত্র ১৬ শতাংশ ডলারে হয়। ডলারে যা মাত্র পাঁচ বছর পূর্বেও ছিল ৪০ শতাংশ। বর্তমানে বৈদেশিক লেনদেনের ১৩ শতাংশ হয় চৈনিক মুদ্রায় এবং এটি ঊর্ধ্বমুখী।
দেখা যাক সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কারের ক্ষতি রাশিয়া কীভাবে মোকাবিলা করতে পারে। পাশ্চাত্যের অর্থনীতি ডলার-ভিত্তিক এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সুইফট সিস্টেমের মাধ্যমে ট্রানজেকশন করে। দীর্ঘদিন বিশ্ব অর্থনীতির চালকের আসনে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এই সুইফট সিস্টেমের বিকল্প কোনো সিস্টেম কার্যকর করা যায়নি। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে চীনের উত্থান এবং রাশিয়া ঘুরে দাঁড়ানোয় বিকল্প অর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। চীন Cross Border Inter Bank Payment System (CBIBPS) এবং রাশিয়া সিস্টেমা পেরেডাচি ফাইন্যান্সোভিখ সুবচেইনি বা System For Transferring Financial Messages (SPFS) পদ্ধতি চালু করে।
২০১৪ সালে প্রবর্তিত এবং ২০১৭ সালে চালু হওয়া এই এসপিএফএস আর্থিক ব্যবস্থাপানার সাথে বর্তমানে চীন, ইরান, ভারত, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, জার্মানি ও সুইটজারল্যান্ড যুক্ত রয়েছে। এই সিস্টেমের সাথে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর ২৪টি ব্যাংকসহ ৪০০ ব্যাংক যুক্ত এবং ২০২০ সাল নাগাদ রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির এক পঞ্চমাংশ এই সিস্টেমে লেনদেন করে। সুইফট সিস্টেম থেকে বহিষ্কারের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের পূর্বেই তার দেশের রিজার্ভ সিস্টেম পুনর্গঠন করেন। পুনর্গঠিত অর্থনীতির সুবাদে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার জাতীয় রিজার্ভ দাঁড়ায় ৬৫০ বিলিয়ন ডলার, আকারের দিক থেকে যা বিশ্বে চতুর্থ। ডলার নির্ভরতা কমানোর জন্য পুতিন এই রিজার্ভ গোল্ডে রূপান্তর করেন।
রাশিয়া একটি বিশাল অর্থনীতির দেশ হওয়ায় সুইফট সিস্টেম থেকে একে বাদ দিলে অন্যান্য দেশগুলোও তাদের নিজস্ব স্বার্থে বিকল্প ব্যবস্থায় আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে। এমনকি এসপিএফএস সিস্টেমকেই বিকল্প সিস্টেম হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। তবে রাশিয়ার বিশ্বব্যাপী ইলেক্ট্রনিক নেটওয়ার্ক সীমিত হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থা প্রসিদ্ধ হতে সময় লাগবে।
ইউক্রেনের জিডিপি ১৫৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। দেশটি রাশিয়ার দখলে চলে গেলে রাশিয়ার অর্থনীতির সাথে ৮ শতাংশ জিডিপি যুক্ত হবে। রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ২২৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এর অর্থ দাঁড়ায় রাশিয়াকে বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের ৫ শতাংশ হারাবে। তার মানে হলো রাশিয়াকে সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ দিলেও রাশিয়া ইউক্রেনের অর্থনীতি থেকে কতকাংশ পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে।
আবার তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিছু দেশের জন্য মানা সহজ হলেও সবার জন্য সহজ হবে না। পুতিন জানেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের কৌশলে এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পার্থক্য থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গ্যাস চাহিদার ৪০ শতাংশ মেটে রাশিয়ার কাছ থেকে আর যুক্তরাজ্যের প্রয়োজন হয় মাত্র ৩ শতাংশ। যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে মতপার্থক্য দেখা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। জার্মানি রাশিয়ার সাথে তার নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প স্থগিত করায় রাশিয়ার অর্থনীতি ধাক্কা খাবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর সরাসরি প্রভাবে পশ্চিম ইউরোপের জ্বালানির যে মূল্য বৃদ্ধি ঘটবে, সেই ক্ষতি ইউরোপ কীভাবে মোকাবিলা করবে তা-ও ভাবতে হবে বৈকি।
আবার রাষ্ট্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর না হওয়ার কথা চিন্তা করেই পাশ্চাত্য রাশিয়ার অভিজাত ধনকুবেরদের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। উদ্দেশ্য পুতিনকে শক্তিহীন করে ফেলা। এই প্রক্রিয়া ২০১৪ সালের পর থেকেই শুরু হয়, কিন্তু পুতিনকে শক্তিহীন করা যায়নি। কেননা বিদেশে পুতিনের নিজ নামে কোনো সম্পদ নেই। পুতিনের একদল অন্ধ সমর্থকের নামে তাঁর সম্পদ রাখা আছে। রাশিয়ার অন্যান্য অভিজাতগণও একই কৌশল অবলম্বন করেন। সুতরাং ব্যক্তির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অলিগ্রেসিকে দুর্বল করতে পারবে বলে মনে হয় না।
এসব কারণে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এসব আর্থিক নিষেধাজ্ঞা খুবই হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং এটি বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। কেননা রাশিয়া বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ায় এর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কুফল সরাসরি এর সঙ্গে লেনদেনকারী যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সকল ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর ওপর পড়বে। এ জন্য যত দিন যাচ্ছে সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের আসলে কোনো বিকল্প নেই বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।
লেখক : বিভাগীয় সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়