ভারতীয় ক্রিকেট বিজ্ঞাপন যখন বুমেরাং
‘অফসাইডে প্রথমে ঈশ্বর, তার পরে সৌরভ’—এমন উক্তি প্রচলিত যে দেশে, সেখানে ক্রিকেট খেলার অবস্থান কোন পর্যায়ে, তা বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। বহু ভাষা, জাতীয়তা আর মতামতের দেশ ভারতে অনেকাংশে বৃহত্তম ‘ধর্মে’র নাম ক্রিকেট। বিজ্ঞাপনী স্টান্টবাজি আর মুনাফার জন্য এমন পরিস্থিতি রীতিমতো রসগোল্লা। দুর্ভাগ্যক্রমে, টিম ইন্ডিয়ার জন্য এই বিজ্ঞাপনী প্রচার উল্টো বুমেরাং হয়ে কাজ করছে বহুদিন ধরে।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই চলে আসে ‘মওকা মওকা’ বিজ্ঞাপনটি। ‘মওকা’র উৎপাতে অতিষ্ঠ ক্রিকেটভক্তরা তাদের চূড়ান্ত বিরক্তিটা ঝাড়তে পেরেছেন গতকাল। ভারতের এতদিনের ঠান্ডা মাথার অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও বেগ পেতে হয়েছে মেজাজ ধরে রাখতে। আবেগের আবরণ শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে সংবাদ সম্মেলনে। ঠিকই তো, নিজেদের ‘প্রোডাক্ট’ যদি নিজেদেরই এভাবে ধুয়ে দেয়, তাও তথাকথিত ‘বাচ্চা’দের সঙ্গে খেলতে নেমে, তাহলে কেই বা আর সহ্য করতে পারে! যেকোনো পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপটে অবিচল ধোনি সিরিজের শুরুতে মুস্তাফিজের মতো ১৯ বছরের ‘নাদান শিশু’ (বাংলাদেশ দল যদি ‘বাচ্চা’ হয়, মুস্তাফিজ তো তবে নাদান শিশু!) ডেবুট্যান্টকে গুঁতো মেরে বসলেন। বিষয়টা কি শুধু রাগ, খেলার মাঠের তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি? নাকি মাথার ওপর গেঁড়ে বসা রাজ্যের চাপ, যে চাপটা তৈরি করেছে ভারতীয় বিজ্ঞাপন-বাণিজ্য?
এক নিমেষে চলে যাওয়া যাক ’৯৯ সালের বিশ্বকাপে। তখন বাংলাদেশ ‘আপসেট’ ঘটিয়ে পরাক্রমশালী পাকিস্তানকে হারাল। তার পরও পাকিস্তান গিয়েছিল ফাইনাল পর্যন্ত, ভারতও বহুদূর। দুই দলেই তখন লিজেন্ডারি সব খেলোয়াড়। বিশ্বকাপের পর অস্ট্রেলিয়া সফরে ৩-০-এর ধোলাই হজম করেছিল ভারত। বলা বাহুল্য, শ্রীনাথ-প্রসাদ-আগারকারের ‘দুর্দান্ত’ পেস অ্যাটাকে বলীয়ান স্টার স্পোর্টস ওই সিরিজটির নাম দিয়েছিল ‘বারুদ’! ভারতের তারকা কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান বা ‘দুর্দান্ত’ পেস অ্যাটাক, কেউই বিশেষ বারুদ নামকরণের সার্থকতা টেকাতে পারেননি, নিজেদের বারুদে নিজেরাই পুড়ে ছারখার হয়ে ফেরত এসেছিলেন দেশে।
বহু পুরোনো গল্প টেনে আনা অন্য কারণে। ‘বারুদ’-এর মতো হয়তো এমন অনেক ডিনামাইট-পিস্তল-কামান মার্কা মিডিয়া স্টান্টবাজি ভারতে খুঁজলে মিলবে। কারণ, এখানে মানুষের ক্রিকেটের জন্য বেশুমার আবেগ আর ভালোবাসাকে বড় পুঁজি হিসেবে প্রতিটি মুহূর্তে খাটানো হয়। ’৯৯ সাল দিয়ে শুরু করা একটা কারণেই, ‘শিশু’ বাংলাদেশের উত্থানও সে বছরেই।
‘বারুদ’ থেকে ‘বাচ্চা’—মিডিয়া ম্যানিপুলেশনের এই লিগ্যাসি ভারত গত ১৬ বছর অক্ষুণ্ণ রেখেছে ধারাবাহিকভাবে। এর মান, ধরন এবং ইনভেস্টমেন্টে বৈচিত্র্য এবং উদ্দেশ্যও এসেছে নতুন নতুন আঙ্গিকে। এখন ভারতের প্রতিটি সিরিজ, প্রতিটি খেলা বিজ্ঞাপনী অতিশায়নে দুষ্ট। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলায় ‘এক ওভারে ম্যাচ বদলে যাওয়ার গল্প’ দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, ধোনির দুই বলে দুই ছক্কায় কেমন করে নাকাল হলো পাকিস্তান! ক্রিকেট-নিয়তি বড় রসিক, বাস্তবে ওই সিরিজে শেষমেশ দুই বলে দুই ছক্কা হজম করেই ম্যাচ খোয়াতে হয়েছিল টিম ইন্ডিয়াকে (মেরেছিলেন শহীদ আফ্রিদি, স্মৃতি যদি প্রতারণা করে না থাকে!), নিজেদের পণ্যে নিজেদের নাকাল হওয়ার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? তবুও বিজ্ঞাপনী অতিশায়নে অন্যান্য দলকে অকারণে অপমান করা, নেগলেক্ট করা বা অশ্রদ্ধা দেখানো বন্ধ হয়নি ভারতীয় বিজ্ঞাপন জগতে। এহেন কার্যক্রম যখন বুমেরাং হয়ে নিজেদের ঘাড়ে বাড়ি মারে, তখন মাথা খারাপ না হয়ে উপায় কী?
গেল বিশ্বকাপের ‘উই ওন্ট গিভ ইট ব্যাক’, ‘মওকা মওকা’র জ্বালা এখনো দগদগে হয়ে জ্বলছে—সেই কাঁচা ক্ষতে নির্মম আগুন জ্বালিয়ে দিল ‘বাচ্চা’ কাহিনী। মিরপুরে দর্শকদের ‘মওকা মওকা’ বিদ্রূপ মহেন্দ্র সিং ধোনিকে যেভাবে হজম করতে হলো, তার দায় কি ভারতের অতি উৎসুক বিজ্ঞাপনী সংস্থা তথা সামগ্রিক মিডিয়া নেবে?
গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যম হলেও বাংলাদেশে টুইটার এখনো অতটা ‘সামাজিক’ হয়ে উঠতে পারেনি, আনন্দ থেকে অভিযোগ—সবকিছুরই ক্ষেত্র এখনো ফেসবুক। বাংলাদেশের সর্বস্তরের ফেসবুক ইউজাররা এখন মনের সুখে ট্রল করছেন, সেসব ট্রলের রকমফের দেখলে অতি গোমড়া লোকেরও পেট ফেটে হাসি বেরোতে বাধ্য। বিষয় হচ্ছে, বিশ্বকাপের সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ভারতকে নিয়ে যতগুলো ট্রল হচ্ছে—তার উৎপত্তিটা একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করুন। দেখবেন, সেগুলোর উৎপত্তি কিন্তু ভারতেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে (!) সেগুলো তাদের জন্যই ভয়ংকর নেতিবাচক হিসেবে কাজ করছে।
এ পরিস্থিতিতে ভারতের অবশ্যই মনোযোগী হওয়া দরকার, কী করণীয়, এটা ভেবে। দিনের পর দিন ‘এমন’ বিজ্ঞাপন বানিয়ে তার যন্ত্রণায় নিজেরাই পুড়লে সেটা নিয়ে তো জরুরি ভিত্তিতে ভাবা দরকার, নাকি! ভারতীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভরা বরং প্রতিপক্ষকে শ্রদ্ধা করে নিজেদের একটু ‘খাটো’ করে দেখানোর স্টোরিবোর্ড লিখতে পারেন, দেখা যাক তাতে ভাগ্যে বদল আসে কি না!
পরিশেষে রমেশ সিপ্পির বিখ্যাত ‘শোলে’ চলচ্চিত্রের একটি অংশের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি—
জয়-বীরুর হাতে নাকাল হয়ে ডেরায় ফেরত এসেছে গব্বরের দুর্ধর্ষ তিন ডাকাত। হিংস্র গব্বর সিং বলছে, “ও দো থে, অউর তুম তিন। ফির ভি ওয়াপ্স আগয়্যি! খালি হাত! কেয়া সমঝকার আয়ে থে-কে, ‘সর্দার বহুত খুস্ হোগা, সাবাসি দেগা কিও’?” (“ওরা দুজন ছিল; তোমরা তিনজন। তবুও পালিয়ে এসেছ। খালি হাতে। কী ভেবে এসেছিলে—যে ‘সর্দার অনেক খুশি হবে, বাহবা দেবে’?”)
‘বাচ্চা’দের হাতে এমনতর নাকাল হয়ে দেশে ফিরছে ভারত, খালি হাতে। দেশে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, কে জানে! ‘বাচ্চা’দের এমনতর ধোলাই খেয়ে খালি হাতে ফেরার ফিডব্যাক নিশ্চয়ই সুবিধার হওয়া কথা নয়, বিশেষ করে যে দেশে ‘মওকা’র মতো বিজ্ঞাপন তৈরি হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে!