হতাশায় মোড়ানো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ, নেপথ্যে যা ছিল
এক রাশ স্বপ্ন নিয়ে ভারতে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপে এবার ভালো কিছু করবে বাংলাদেশ, সেই আশায় বুঁদ ছিল ভক্তরা। ক্রিকেটাররাও ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে দারুণ এক জয়ে আশার পালে লেগেছিল জোর হাওয়া। এরপর সব শেষ। টানা ছয় হার, যার একটিতেও ন্যূনতম ব্যবধান গড়তে পারেনি সাকিব আল হাসানরা। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং— তিন বিভাগেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দেয় বাংলাদেশ। ৯ ম্যাচে কেবল দুটি জয়, হার সাতটিতে। ২০০৩ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে ছয়টি করে ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ। এতদিন এটিই ছিল বিশ্বকাপে এক আসরে লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের সবচেয়ে বেশি হারের লজ্জা। এবার সাত পরাজয়ে নতুন লজ্জা নিয়ে দেশে ফিরেছে দলটি। ছন্দে থাকা একটা দলের বিশ্বমঞ্চে হঠাৎ এমন অধঃপতনের পেছনে আছে মাঠ ও মাঠের বাইরের নানা কারণ। সেসব খোঁজার চেষ্টাই করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
শুরুর আগেই বিতর্ক
বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ১০ দলের মধ্যে সবার শেষে দল ঘোষণা করে বাংলাদেশ। দল ঘোষণার পর রীতিমতো চমকে ওঠে সবাই। ১৫ জনের স্কোয়াডে তামিম ইকবাল নেই। দেশসেরা ওপেনারের না থাকা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। তামিমকে আনফিট দেখিয়ে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে আসে সাকিব-তামিমের পুরোনো দ্বন্দ্ব। বিশ্বকাপ দলকে শুভকামনা জানানোর বদলে দেশের ক্রীড়াঙ্গন মেতে ওঠে তামিমবিহীন বিশ্বকাপ দলের সমালোচনায়। তামিম সংক্রান্ত বিষয়ের আগে লম্বা সময় ধরে ক্রিকেটাঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছিল আরেক অভিজ্ঞ তারকা মাহমুদউল্লাহকে দলে না রাখাটা।
সাকিব-তামিম দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে সাকিব-তামিম ইস্যুটা বহু পুরোনো। গত কয়েক বছর ধরেই দুজনের সম্পর্ক খারাপ চলছিল। জুনিয়ররা দ্বিধা ও ভয়ে থাকতেন, কখন কোন কথা বললে সাকিব বা তামিমের বিপক্ষে চলে যায়। বিশ্বকাপে তামিমকে না রাখার ঘটনায় প্রকাশ্যে আসে সেটি। বিশ্বকাপ দলে না থাকা নিয়ে তামিম বলেন, ‘আমাকে বোর্ডের একজন শীর্ষ কর্তা ফোন করে হঠাৎ করে বললেন, তুমি তো বিশ্বকাপে যাবা, তোমাকে তো ম্যানেজ করে খেলাতে হবে। তুমি প্রথম ম্যাচ খেইলো না। খেললেও আমরা তোমাকে নিচের দিকে ব্যাটিং করানোর কথা ভাবছি। তাকে বলেছি, এই নোংরামির মধ্যে আমি থাকতে চাই না। আপনাদের আমাকে বিশ্বকাপে পাঠানোর দরকার নেই।’
তামিমের কথার পর এক সাক্ষাৎকারে সাকিব বলেন, ’বিসিবির ওই প্রস্তাব মেনে নেওয়া উচিত ছিল তামিমের। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করা যেত। আমি এটা পারব না, আমি ওটা পারব, তোমার এই লাগবে। কিন্তু তার কথাবার্তা আর চিন্তা থেকে মনে হয়েছে সে টিমম্যানই না। আপনি খেলছেন ব্যক্তিগত রেকর্ড এবং সাফল্যের জন্য। নিজের ফেম এবং নেমের জন্য। টিমের জন্য না।’
ম্যানেজমেন্টের দায়
বিশ্বকাপ এমন এক আসর, যার জন্য চার বছর ধরে প্রস্তুত হতে থাকে দলগুলো। আসর শুরুর আগ মুহূর্তে দলকে গুছিয়ে এনে চূড়ান্ত প্রস্তুত করার কথা। সেখানে বিশ্বকাপ দল ঘোষণার আগ থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট। শুরুর আগের সাকিব-তামিম কাণ্ডে নিরব থাকা, বিশ্বকাপ চলাকালীন সাকিবের দেশে আসা, লিটনের একাধিকবার দেশে আসা নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। টিম ম্যানেজমেন্ট যেন সেখানে নিরব দর্শক। তাদের কোনো ভূমিকাই দেখা যায়নি দলে শৃঙ্খলা রাখতে।
ব্যাটিংয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থতা
চলতি বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহর পারফরম্যান্স এক পাশে রাখলে গোটা বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল হতশ্রী। ভারতের ব্যাটিং স্বর্গে ৯ ম্যাচে মাত্র একটি ৩০০ ছাড়ানো ইনিংস বাংলাদেশের। তামিমবিহীন ওপেনিং চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। দলে তৃতীয় কোনো ওপেনার না থাকায় নিরুপায় হয়ে প্রতিটি ম্যাচে খেলাতে হয়েছে তানজিদ তামিমকে। বিশ্বকাপ হচ্ছে সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটানোর জায়গা। সেখানে বাংলাদেশ করেছে উল্টোটা। প্রায় প্রতিটি ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে অদল-বদল করেছে বাংলাদেশ, যেটি ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
বোলারদের অসহায়ত্ব
বিশ্বকাপ শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছিল বাংলাদেশের বোলিং বিভাগ। বিশেষ করে পেস বিভাগকে নিয়ে প্রত্যাশা ছিল তুঙ্গে। তাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদদের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পেস আক্রমণ নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তিরাও। সঙ্গে সাকিব স্পিনে সাকিব, মেহেদী হাসান মিরাজদের নিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ বোলিং আক্রমণই ছিল। কিন্তু, মাঠের ক্রিকেটে দেখা যায়নি এর ছিঁটেফোঁটাও।
অনভিজ্ঞ এক দল
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ১৫ জনের মধ্যে আটজনই নতুন। এবারই প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছে তারা। একটা বিশ্বকাপ দলে অর্ধেকের বেশি অনভিজ্ঞ ক্রিকেটার নিয়ে যাওয়া কতটা যৌক্তিক, তার দেখা মিলেছে মাঠের ক্রিকেটেই। বিশ্বকাপ আর সিরিজ খেলা যে এক নয়, সেটি হয়ত ভুলেই গিয়েছিলেন নির্বাচকরা।
মিরপুরের উইকেট
বাংলাদেশে কোনো খেলা হলে, আমাদের আত্মবিশ্বাস থাকে বাংলাদেশ জিতবে। সেটি গত কয়েক বছর ধরে হয়েও আসছে। মিরপুরের দুর্দান্ত বাংলাদেশ, দেশের বাইরে গেলে যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভারতীয় ক্রিকেটার রবিচন্দ্রন অশ্বিন বলেছিলেন, বাংলাদেশ মিরপুরকেন্দ্রিক দল। তারা দেশের বাইরে খুবই সাধারণ ক্রিকেট খেলে। যার জন্য দায়ী মিরপুরের বাজে উইকেট। অন্যান্য দল যেখানে আধুনিক ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্পোর্টিং উইকেট তৈরি করে, মিরপুরে মান্ধাতা আমলের উইকেট বানিয়ে ক্রিকেটারদের ধ্বংসপ্রায় করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, দ্রুতগতির স্পোর্টিং উইকেটে ঘটেছে চূড়ান্ত পতন।
চাইলে অনেক বাহানা দেওয়া যায়। তবে, দুই যুগ ধরে ক্রিকেট খেলা একটা দলের বিশ্বকাপ মিশন এত বাজে হওয়াটা অশনী সংকেতই। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অবশ্য কিছু না কিছু অজুহাত সবসময়ই বের করে।
আমেরিকার কিংবদন্তি নারী ক্রীড়াবিদ আলথিয়া গিবসন একবার বলেছিলেন—‘পরাজিত ব্যক্তির সবসময় বাহানা তৈরি থাকে, যেখানে বিজয়ীর ভাবনায় থাকে পরবর্তী পদক্ষেপ। কাজ সম্পর্কে পরাজিতের দৃষ্টিভঙ্গি, এটি হয়ত সম্ভব কিন্তু কঠিন। আর বিজয়ী ভাবে, এটি কঠিন কিন্তু সম্ভব।’
ষাটের দশকে বলা টেনিস ও গলফের এই তারকার কথার সঙ্গে বাংলাদেশ দলের বর্তমান অবস্থা খুব বেশি করেই মিলে যাচ্ছে।