মানুষের প্রয়োজন কমছে স্পেনের লাইটহাউসে
সমুদ্র উপকূলে লাইটহাউস মানুষের মধ্যে রোমাঞ্চ, স্বপ্ন ও কল্পনা জাগিয়ে তোলে। স্পেনে আজও কয়েকটি লাইটহাউসে মানুষ সবকিছু পরিচালনা করে। কিন্তু ধীরে ধীরে এমন পেশা লোপ পেতে চলেছে। সমুদ্রের বুকে, উপকূল থেকে ২৩ নটিক্যাল মাইল দূর পর্যন্ত আলো নিক্ষেপ করেন মারিও সানৎস। স্পেনের দক্ষিণে আন্দালুসিয়া অঞ্চলে ফারো দে মেসা রলদানের লাইটহাউসে ৩২ বছর সময় কাটিয়েছেন মারিও। এখন তিনি স্পেনের শেষ লাইটহাউস কিপারদের একজন। নিজের পেশা সম্পর্কে মারিও বলেন, ‘কখনো আমার নিজেকে স্বর্গরাজ্যে এক বাড়ির মালিক মনে হয়। ভাবি, এত সুন্দর জায়গায় কাজের সুযোগ সত্যি কি আমার প্রাপ্য? এটা সত্যি এক অসাধারণ প্রাপ্তি৷ কয়েক বছর পর আমার সেই উপলব্ধি হয়েছিল।’
এক কালে স্পেনের উপকূল জুড়ে প্রায় ৫০০ প্রহরী লাইটহাউসে সক্রিয় ছিলেন। মারিওর অনুমান, বর্তমানে বড়জোর ১৫ জন অবশিষ্ট রয়েছেন। প্রতিদিন তিনি ১৬০ বছর পুরানো ভবনটির যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আগে তেল দিয়ে আলো জ্বালানো হতো। আজ বিদ্যুতেই সেই কাজ হয়৷ মারিও মনে করেন,‘লাইটহাউস চিরকাল জাদুময় ছিল৷ আলো-ছায়ার খেলা, অন্ধকারের মধ্যে আলোর ঝলক৷ শুধু জাহাজই নয়, আমাকেও সেই আলো আকর্ষণ করেছিল৷ এখান থেকে সবকিছু অন্যরকম দেখায়।’
আলোক ছটায় বাধা এড়াতে জানালা পরিষ্কার করতে হয়। ৬৩ বছর বয়সি মানুষটার জন্য মাথা ঘোরা উচ্চতায় সেই কাজ রুটিন হয়ে গেছে৷ মারিও বলেন,‘আমি সে বিষয়ে কখনোই মাথা ঘামাই নি। আমাকে ভূমধ্যসাগরে সবচেয়ে উঁচু চালু লাইটহাউসে পাঠানো হয়েছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। মাথা ঘোরার ব্যামো থাকলে আগেই আমার অসুবিধা হতো।’
মারিও নিজের লাইটহাউস নিয়ে গর্বিত। তিনি জানেন, যে পুরানো এই স্থাপনা আধুনিক যুগেও অপরিহার্য। তিনি বলেন,‘জিপিএস ভালো জিনিস। কিন্তু প্রায় সব জাহাজের ক্যাপ্টেনই বলেন, যে তাঁরা সব সময়ে লাইটহাউসের বাতির দিকে নজর রাখেন। স্যাটেলাইটে গোলোযোগ হতে পারে। কিন্তু লাইটহাউস সব সময়ে হাতের নাগালেই রয়েছে।’
মারিও মাদ্রিদ শহরে বড় হয়েছেন, যা সমুদ্র থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানে তাঁর একটা পানশালা ছিল। তারপর তিনি মেরিন সিগনাল মেকানিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জনবহুল শহর ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেই উপলব্ধি সম্পর্কে মারিও বলেন,‘শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলে মানুষ টের পায় যে, সে প্রকৃতির অংশ। একদিকে স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠে এবং মানুষ নিজের বাড়তি ক্ষমতা টের পায়। অন্যদিকে উপলব্ধি হয়, যে তুমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র এক কণার মতো।’
স্পেনের সবচেয়ে নতুন ও আধুনিক লাইটহাউস ‘ফারো দে মোখাকার’-ও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেখানে কোনো মানুষ থাকে না, সবকিছু রিমোট কনট্রোলে চলে। ভবিষ্যতে এমনটাই ঘটবে। সপ্তাহে একদিন মারিও সেখানে ঢুঁ মারেন। নতুন প্রবণতা সম্পর্কে মারিও সানৎস বলেন, ‘আমার লাইটহাউস ১৬০ বছর পুরানো। এটার বয়স সবে তিন। দুটিই পরিবর্তনের প্রতীক। অতীতে অনেক মানুষ স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতেন। আজকাল টেলি-ওয়ার্ক, হোম অফিস বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। লাইটহাউসের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটছে। আমার সেটা দুঃখজনক মনে হলেও এটাই অগ্রগতির লক্ষণ।’
শেষ লাইটহাউসও রিমোট কন্ট্রোলে চলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।