ঋণ পুনর্গঠনে শ্রীলঙ্কার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে চীন

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : সংগৃহীত

গত বছরের আগস্টে শেষ দিনে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে একটি সুপারমার্কেটের বাইরে গ্রাহকদের দীর্ঘ সারির ছবি প্রকাশ করেছিল নিউজ চ্যানেল সিএনবিসি। সেদিন শ্রীলঙ্কা খাদ্য ঘাটতির জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। দেশটির বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমদানি অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

এর ফলে চিনি, চাল, পেঁয়াজ ও আলুসহ দ্রব্যের দাম চরম বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানোর জন্য সরকার ভোজ্যতেল ও হলুদ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

শ্রীলঙ্কা করোনা মহামারিতে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ। করোনার কারণে দেশটির পর্যটন খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল এ পর্যটন খাত। এখান থেকে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং চীনের কাছে বিশাল ঋণের বোঝা দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। সংবাদমাধ্যম দ্য হংকং পোস্ট এ খবর জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা প্রায় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে। ২০২১-২২ সালে এ ঋণের মাত্র ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো পরিশোধ করতে পেরেছে দেশটি। এ ঋণের বোঝা সাধারণ লঙ্কান জনগণের জীবনে বয়ে এনেছে ভয়াবহ পরিণাম।

হাম্বানটোটা বন্দর ও কলম্বো পোর্ট সিটির মতো বিশাল প্রকল্পের জন্য চীনের সংস্থাগুলো ঋণ পরিশোধের কঠোর শর্তে শ্রীলঙ্কাকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিয়েছে। প্রায় ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের বিপরীতে হাম্বানটোটা বন্দর এর মধ্যেই চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করে বলেছিল, দেশটির ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তার মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর করতে হবে। যদিও ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৩৬ কোটি মার্কিন ডলার, যেখানে দেশটির ঋণের পরিমাণই ছিল ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।

এমন সংকটজনক পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধের বিষয়ে আবার বিবেচনা করার জন্য চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, চীন কলম্বোর ওই অনুরোধ নাকচ করেছে।

যদিও চীন অস্পষ্টভাবে শ্রীলঙ্কাকে আশ্বাস দিয়েছে যে, তারা কলম্বোকে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের অস্থিতিশীল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সঙ্গে বৈঠকে সহায়তা চাইলে বেইজিং ওই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

চলতি মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান আবারও শ্রীলঙ্কার বিষয়ে জানিয়েছিলেন, চীন দেশটির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করে আসছে এবং তারা শ্রীলঙ্কার পাশে থাকবে। যদিও চীনের এই আশ্বাস এখন লঙ্কান জনগণের কাছে গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।

শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকার গভীরভাবে চীনপন্থি হিসেবেই পরিচিত। চীনপন্থি হওয়ার কারণে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, এমসিসি’র বোর্ড পরিচালকেরা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তাদের চার কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার চুক্তি নাকচ করে দেয় এই মর্মে যে, ‘এই প্রজেক্ট চালিয়ে নিতে অংশীদার দেশের আগ্রহের অভাব হয়েছে।’ শ্রীলঙ্কার  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করার জন্য এ প্রজেক্টটি সাজানো হয়েছিল। এর ফলে কলম্বোতে যানজট কমে যেত এবং বায়ু দূষণ এবং গণপরিবহণ উন্নত; এ ছাড়া কৃষকদের তাদের পণ্য বাজারে পেতে সাহায্য করার জন্য প্রাদেশিক রাস্তাগুলো উন্নত করা হতো এবং এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ক্ষুদ্র কৃষক এবং অন্যান্য জমির মালিকেরা নিরাপদে জমির রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেন।

২০১৯ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং সাধারণ নির্বাচনে এমসিসি অনুদান একটি উত্তপ্ত ও বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। তবে, মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই প্রকল্পে কলম্বোর মত পরিবর্তন হয়।

এদিকে, চীনের সহায়তায় শ্রীলঙ্কায় যে প্রকল্পগুলো আসছে, সেগুলো দেশটিকে আরও ঋণগ্রস্ত করে ফেলছে। শ্রীলঙ্কার স্থানীয় মানুষ এর মধ্যেই কিছু প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুরু করেছে। কারণ, এগুলো তাদের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করছে।

যেমন, হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দরের সঙ্গে ১৫ হাজার একর জুড়ে একটি শিল্প পার্ক গড়ে ওঠার কথা রয়েছে। প্রস্তাবিত ওই পার্কের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ প্রতিবাদ করছে। কারণ, তারা আশঙ্কা করছেন ওই এলাকা একটি চীনা উপনিবেশে পরিণত হবে। এসব বিক্ষোভে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও জড়িত।

শ্রীলঙ্কায় চীনের যেসব প্রকল্প আসছে, তাতে কাজ করছে হাজার হাজার চীনের নাগরিক। চীন থেকে হান জাতিগোষ্ঠীদের কাজের জন্য আনা হচ্ছে, এতে ক্ষতি হচ্ছে শ্রীলঙ্কার আদিবাসীদের।

হাম্বানটোটা এলাকা চীনের উপনিবেশ হয়ে যাবে বলে যে আশঙ্কা সাধারণ মানুষের রয়েছে, তা একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। সিনহুয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক পোর্ট গ্রুপ এরই মধ্যে টায়ার এবং পরিবারের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির মতো জিনিস তৈরির জন্য চীনাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। চীনা শ্রমিকদের আগমনের কারণে হাম্বানটোটায় স্থানীয় লোকজন চীনা সবজি, যেমন—বাঁধাকপি, চয় সাম ও কেল বিক্রি করছে।

শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থায়নে আরেকটি বিশাল প্রকল্প কলম্বো বন্দর সিটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটি শ্রীলঙ্কার উপকূলরেখা, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, মৎস্য সম্পদ ও প্রজনন স্থানগুলোকে ক্ষয় করে সমুদ্রের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। সমুদ্র থেকে জীবিকা নির্বাহকারী প্রায় ৮০ হাজার জেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এদিকে ঋণ সংকটের জন্য শ্রীলঙ্কার ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে চীন। চীনের একদল গবেষক বলছেন, কী কারণে দেশটির এমন পরিনতি, তা তারা খুঁজে বের করতে পেরেছেন। সেসব কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তি, দীর্ঘ সময় ধরে লঙ্কান সরকারের নেওয়া অত্যধিক ঋণ এবং একটি অনুপযুক্ত ঋণ কাঠামো।

অন্যদিকে, বেইজিং, কলম্বোর সংকটের পেছনে তার দায়মুক্তির অজুহাত দেখিয়ে বলেছে, তার দেশ কখনোই শ্রীলঙ্কাকে টাকা ধার করতে বাধ্য করেনি, শ্রীলঙ্কা ঋণের জন্য অনুরোধ করেছে। তাই চীনকে দোষ দেওয়া যায় না। চীন বলছে, ঋণগ্রস্ত দেশের ঋণ সমস্যা কখনোই ঋণদাতা দেশের দায়িত্ব হতে পারে না।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির এ দুরবস্থায় চীন দায়সারা দুঃখ প্রকাশ করলেও রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও জনগণের দুর্ভোগ নিরসনে তারা কিছুই করেনি।

তবে এখন প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো, এ পরিস্থিতি কীভাবে চীনের প্রতি কলম্বোর মনোভাবকে প্রভাবিত করবে এবং চীন ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে চূড়ান্ত সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।

এদিকে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও নেপালের মতো দেশগুলোকে চীনা বিনিয়োগ প্রকল্প স্থগিত করতে প্ররোচিত করছে। চীনের ত্রুটিপূর্ণ বিনিয়োগ মডেলগুলোসহ চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কম অংশগ্রহণমূলক প্রতিকূল বাণিজ্য ভারসাম্যও শ্রীলঙ্কার এ অবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বরে চীনে লঙ্কান রপ্তানি ছিল ৬৬ মিলিয়ন ডলার, যেখানে চীন থেকে আমদানি ছিল ৫০৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, কলম্বোর জন্য নেতিবাচক বাণিজ্য ভারসাম্য ছিল ৪৪০ মিলিয়ন ডলার।