করোনায় এত কাবু কেন ইতালি, মন্দায় পড়তে যাচ্ছে দেশটি?
করোনাভাইরাসের উৎসস্থল চীন বিপদ কাটিয়ে ওঠার পথে থাকলেও ভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত ইতালি। পরিস্থিতি সামলাতে গত সোমবার গোটা ইতালিকেই কোয়ারেন্টাইনে (রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় পৃথক করে রাখার বিশেষ ব্যবস্থা) নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ইউরোপের দেশ হয়েও এমন বেহাল দশায় কেন পড়ল ইতালি। তারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে।
বিশ দিনের ব্যবধানে মাত্র তিনজন থেকে ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। দেশজুড়ে চলমান জরুরি অবস্থার জেরে অর্থনৈতিক মন্দারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির অর্থ উপমন্ত্রী লরা কাস্তেল্লি জানিয়েছেন, সব ধরনের ঋণের বন্ধকির শর্ত এবং সব কর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে সাহায্যের জন্য সাড়ে আটশ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ইতালিতে করোনার প্রকোপ
দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক ১৬৮ জনের মৃত্যুতে প্রাণহানির সংখ্যা ছয়শ ছাড়িয়েছে। ১০ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। ইউরোপের আর দশটা দেশের তুলনায় ইতালিতে করোনাভাইরাস মারাত্মকভাবে কেন ছড়াল, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি ৩৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ভাইরাস নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় লোম্বার্দির হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, এর অনেক আগেই ইতালিতে ঢুকেছে করোনাভাইরাস। ইতালির জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ফ্লাভিয়া রিকার্ডো জানান, কিছুদিন ধরে নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে বহু মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন।
তবে এই লোম্বার্দিতেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। মোট আক্রান্তের ৮৫ শতাংশই ইতালির উত্তরের এ অঞ্চলের। আর করোনায় মৃত্যুর ৯২ শতাংশ ঘটনা এখানকার। তবে ইতালির ২০টি অঞ্চলের প্রতিটিতেই করোনা রোগী পাওয়া গেছে।
ইতালিতে এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন?
এর পেছনে দূষণকে অন্যতম কারণ ধরা হচ্ছে। ইউরোপের দূষিত ১০০ শহরের ২৪টি ইতালিতে। দেশটির একটি ক্লিনিকের পরিচালক বলেন, ‘আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এই (করোনাজনিত) রোগে বয়স্কদের মৃত্যুহার বেশি। আমাদের দেশে করোনায় মৃতদের গড় বয়স ৮১ বছর।’
তবে সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, ধরা পড়ার আগেই বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। এত বেশি মানুষের মৃত্যুর পেছনে এটিও একটি কারণ। ফ্লাভিয়া রিকার্ডো বলেন, ‘আমরা বুঝে ওঠার আগেই এটি চেইনের মতো নানা জায়গায় সংক্রমিত হয়ে পড়ছে। এ পর্যন্ত ৪২ হাজার রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। আরো বেশি পরীক্ষা করা প্রয়োজন।’
সরকারের প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ইতালিতে করোনাভাইরাস ধরা পড়ারও এক মাস আগে ভাইরাস পর্যবেক্ষণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করে। তবে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর অনেকেই চীন থেকে অন্য দেশ হয়ে তার পর দেশে ফেরেন।
কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলছেন, ওই টাস্কফোর্স গঠনেরও কয়েক দিন আগে ইতালিতে করোনাভাইরাস প্রবেশ করে। এবং এরপর অবাধে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায় ভাইরাসটি।
সরকার এখন কতটা তৎপর?
টাইম ম্যাগাজিন বলছে, চীনের বাইরে যেসব দেশে করোনা ছড়িয়েছে, তার মধ্যে ইতালিই সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। গোটা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সব ধরনের গণজমায়েত বন্ধ। গোটা ইতালি এখন কোয়ারেন্টাইনে। নাইটক্লাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, খেলাধুলার আয়োজন সবই বন্ধ রাখা হয়েছে। চলছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। অযাচিত ভ্রমণে ২৩৪ মার্কিন ডলার জরিমানাও ধার্য করা হয়েছে। তবে বিদেশিদের ইতালি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা নেই।
এ ছাড়া জেলখানায় দর্শনার্থীদের যাওয়া নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ২৭টি জেলখানায় বিক্ষোভও করেছে বন্দিরা।
এসব পদক্ষেপের প্রশংসাই শোনা যাচ্ছে চারদিকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস আধানম টুইট করে ইতালি সরকারের শক্ত অবস্থানের প্রশংসা করেছেন। তবে এসব কড়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হলেও ইতালির দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা প্রবাসী শ্রমিকরা বিপদেই পড়তে যাচ্ছেন। এই জরুরি অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে শ্রমিকদের জীবনে করুণ পরিণতি নেমে আসবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এসব পদক্ষেপ দীর্ঘদিনের জন্য কার্যকর না রাখতে পারলে কোনো লাভ হবে না। মহামারিকে অল্প কিছুদিনের জন্য দূরে সরিয়ে রেখে কোনো ফায়দা হবে না।
ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী হাল?
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো নয়। ইতালির প্রবৃদ্ধির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্য খাতে। জার্মানি, ফ্রান্সসহ অন্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় এটি অনেক কম। তা ছাড়া চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে প্রবাসীদের প্রতি অবহেলা বা কম গুরুত্ব দেওয়ার নজির অহরহ।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালগুলোর সংক্রামক ওয়ার্ডে বিছানাসংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছে। লোম্বার্দির গভর্নর আত্তিলিও ফন্তানা আসন্ন শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল স্কুলগুলোকে শিক্ষার্থীর আসন সংখ্যা বাড়াতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে বলেছেন।
ইতালির একটি ক্লিনিকের পরিচালক লরেঞ্জো ক্যাসানি টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা ও গবেষণা খাতে ব্যয়সংকোচন এখন ইতালির গুরুতর সমস্যা। আমরা একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নেই আমাদের। কোনো মহামারি এলে আমরা কী করব, তার কোনো পরিকল্পনা নেই।’
লরেঞ্জো ক্যাসানি আরো বলেন, ‘লোম্বার্দিতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিছানা নেই। চিকিৎসকদের অর্থের ভিত্তিতে চিন্তা করতে হচ্ছে, কে সেবা পাবে আর কে পাবে না।’ তবে অর্থের সংকুলান না থাকলেও নাগরিককে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে ইতালির আইনে।
অথনৈতিক মন্দায় পড়তে যাচ্ছে ইতালি?
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থার ফলে ইতালির অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে ভয়াবহ অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে লোম্বার্দিতে। ইতালির অর্থনীতির এক-পঞ্চমাংশের উৎস এই লোম্বার্দি।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে অবরুদ্ধ পরিস্থিতির ফলে পর্যটন খাতে সৃষ্ট অচলাবস্থায় ইতালি ৮১০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ইতালির মোট প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশই আসে পর্যটন থেকে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপের আগে থেকেই ইতালি আকাশছোঁয়া সরকারি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বিপাকে রয়েছে। প্রবৃদ্ধির ১৩৪ শতাংশ সরকারি ঋণ রয়েছে ইতালির। ইউরোপীয় দেশ হিসেবে নিজ দেশের প্রবৃদ্ধির ৬০ শতাংশের বেশি ঋণ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
ইতালির অর্থনীতিতে আরো খারাপ অবস্থা দেখা দিলে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী জিওসেপ কোঁতে গত সোমবার বলেন, অর্থনীতি রক্ষায় মারাত্মক ঝাঁকি দেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে ভাইরাস মোকাবিলা করা হবে এবং এর ফলে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেওয়া হবে না।
অর্থ উপমন্ত্রী লরা কাস্তেল্লি জানিয়েছেন, সব ধরনের ঋণের বন্ধকির শর্ত ও সব কর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে সাহায্যের জন্য সাড়ে ৮০০ কোটি ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এদিকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১১৫টি দেশ বা অঞ্চলে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৯০ জনে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ২৩০ জন। আর করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬৬ হাজার ৩৩৫ জন।